মুছাপুরে স্লুইসগেট পূণনির্মান না হওয়ায় তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হচ্ছে

Date:

কোম্পানীগঞ্জ সংবাদাতা :

কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুরে স্লুইসগেট পূণনির্মান না হওয়ায় নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে কোম্পানীগঞ্জ, সোনাগাজী ও দাগনভূঞার উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা মুছাপুরে ডাকাতিয়া নদীর ভাঙনে রাস্তা-ঘাট ও বাড়ি-ঘর। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রবল পানির স্রোতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর স্লুইসগেট ভাঙনের কারনে এবং তা পূণঃনির্মান না হওয়ায় নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত হাজার হাজর ঘর-বাড়ি এবং বিস্তীর্ণ ফসলী জমি।

হুমকির মুখে পড়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও সোনাগাজী দাগনভূঞা উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- নদীর তীব্র ভাঙনে মুছাপুর ৭নং ওয়ার্ডের পুরো গ্রাম বিলীন হওয়ার পথে। আজ যেসব বাড়ী-ঘর, গাছপালা ও স্থাপনা দেখা যাচ্ছে সেটি আগামীকাল আর দেখা মিলছে না। এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে নদীর তীব্র ভাঙনকবলিত এই এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১শ বছরের পুরনো বাড়ীও উত্তাল নদীর আগ্রাসী ভাঙনে আজ বিলীন।

মুছাপুর ৭নং ওয়ার্ডের সহস্রাধিক ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ, পারিবারিক কবরস্থান, মক্তব ও জনতা বাজারের দোকান-পাট ও বাড়ী-ঘর বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের কবর দেয়া হয়েছিল বসতভিটার পাশে। নিজের পরিবার ও ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও নিতে পারছেন না স্বজনদের কবরগুলি। মা-বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা সেই কবরটি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।

চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে চোখের পানি ছল ছল করলেও বুকের মাঝে কান্না ধরে রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই নদীর তীব্র ভাঙন কবলিত এই এলাকার মানুষের। সহায় সম্বল হারিয়ে কেউ রাস্তার পাশে, কেউ আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এভাবে নদী ভাঙ্গায় ভুক্তভোগীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শত-শত হেক্টর রোপা আমন ধানক্ষেত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, কৃষকেরা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিন-রাত। অপর দিকে মুছাপুর রেগুলেটরে যাওয়ার প্রধান সড়কটির বেশীর ভাগ অংশ ভেঙে গেছে। বনবিভাগের সারি-সারি ঝাউগাছের বাগানটিরও

অনেক অংশ ভেংগে তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই ভাঙছে নতুন নতুন এলাকা। ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, গাছপালা ও মাছের ঘের। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ, দাগনভূঞা ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার কয়েকটি গ্রাম। স্থানীয়রা জানায়, রেগুলেটর না থাকায় প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পর পর দুই বার জোয়ার আসে। এসময় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর, চরহাজারী, চরপার্বতী ও ফেনীর সোনাগাজীর চরমজলিশপুর ও চরদরবেশ ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামে। এতে প্রতিদিন ভাঙছে এসব ইউনিয়নের অনেক এলাকা গুলো। চলমান ভাঙনের কবলে ইউনিয়নগুলোর আরও কয়েকটি এলাকাও রয়েছে। জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে আশপাশের মাছের প্রজেক্ট ও ফসলি জমিগুলোতে। যার ফলে বিপর্যয় ঘটছে মৎস্য ও কৃষিতে। ইতোমধ্যে ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আমনের খেত, ভেসে গেছে অর্ধশত মাছের পুকুর ও প্রজেক্টের মাছ। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় মারা যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ।
নদী ভাঙনরোধ বন্ধ না হলে কোম্পানীগঞ্জ ও সোনাগাজীর অনেক এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিলীন হতে পারে ১ হাজার হেক্টর জমি, যেখানে চাষ হতো আমন, আউশ, বোরো, সরিষা, তরমুজ, ডাল, সূর্যমুখী, শাক-সবজি। সংকটে পড়বে এ অঞ্চলের কোটি কোটি টাকার কৃষি ও মৎস্য খাত।

স্থানীয় বাসিন্দারা আরও বলেন, রেগুলেটর নদীতে বিলীন হওয়ার পর থেকে একের পর এক স্থাপনা, বাড়িঘর ও কৃষিজমি নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙন চলমান থাকলে কোম্পানীগঞ্জ ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দেশের মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন তারা।

তারা আরও বলেন, বন্যায় এমনিতেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। নদী ভাঙনের কারণে এখন ঘণ্টায় একটি করে পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর হারাচ্ছে।ভেঙে যাচ্ছে মসজিদ, রাস্তা-ঘাট। নদী ভাঙন রোধে বাঁধ গুলো সোজা করা না হলে এখানকার অন্তত ১০০০পরিবার ভিটেমাটি সব হারাবে। আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বাড়ি-ঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজও রাস্তা-ঘাট বাঁচাতে চাই। নদী ভাঙন রোধ করতে ছোট ব্লক ও ছোট জিয়ো ব্যাগ ব্যবহার করা হলেও কাজের কাজ হচ্ছেনা। স্থানীয়রা জানায়, বড় ব্লক এবং বড়

জিয়োব্যাগ ফেলা হলে হয়তো নদী ভাঙন রোধ করা যেত। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রেগুলেটরে ভাঙন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ একর আমন ধানের জমি ও কয়েক একর শীতকালীন সবজির খেত নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এ ভাঙন যেভাবে অব্যাহত আছে ধারণা করা হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় এক হাজার হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে সংকটে পড়বে এ অঞ্চলের কৃষি খাত।

মুছাপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রোজিনা বেগম বলেন, গত ২০ বছর আগে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে গুচ্ছগ্রাম থেকে মুছাপুরে আসেন। স্বামী, মেয়ে, মেয়ের জামাই ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে একটি দোচালা টিনের ঘর করে কাটছিল তার সংসার। মুছাপুর রেগুলেটরের পাশে থেকে মোকাবিলা করেছেন রিমাল, অসনি ও সিত্রাং-এর মতো কয়েকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। কোনোটিতে নিজের ভিটে-মাটি ছাড়তে হয়নি রোজিনাকে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফেনী থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত বন্যার পানির চাপে ভেঙে যায় রেগুলেটরটি। আর এতেই কপাল পুড়ে রোজিনাদের। রেগুলেটর ভেঙে পড়ার কিছুক্ষণ পর নদীগর্ভে বিলীন হয় তার মাথা গোঁজার একমাত্র বসতঘরটি। নদী ভাঙনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সঠিক তালিকা করে পুনর্বাসন করার দাবি জানান তিনি।

মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুরের নদী ভাঙন রোধে ড্রেজিং এর কাজ শুরু করা হয়েছে। যার ফলে গত ২৬আগস্টের পর থেকে বিলীন হয়েছে ওই জনপদের বড় একটি অংশ। ড্রেজিং শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে, তবে ড্রেজিং পরবর্তী আবারও রেগুলেটর স্থাপন করে স্থায়ী সমাধানের দাবি এলাকাবাসির।

সরকারের একাধিক উপদেষ্টা মুচাপুর রেগুলেটর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। নদী ভাঙন রোধে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ছোট ফেনী নদীর জনতা বাজার অংশে ড্রেজিং কাজের শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে স্বস্তি ফিরেছে এ নদী তীরবর্তী ৪টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষের মাঝে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা মেহরাজ জানান, এ ড্রেজিং এর কাজের মাধ্যমে নদীর পানির প্রবাহ পরিবর্তনের পাশাপাশি মাঝ নদী দিয়ে পানি নামা শুরু করলে দুই পাশের আরও কয়েক লাখ মানুষের বসত ঘর রক্ষা হবে। একই সাথে ভাঙন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পুনরায় আরও একটি রেগুলেটর স্থাপনের দাবি তাদের।

উল্লেখ্য, গত ২৬আগস্ট ফেনী থেকে নেমে আসা বন্যার পানির তীব্র চাপে ভেঙে নদী গর্ভে বিলিন হয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর রেগুলেটর। তার আগে বন্যার পানি দ্রুত নামার জন্য খুলে দেওয়া হয় রেগুলেটরের ২৩টি গেট (ভেন্ট)। রেগুলেটরটি নদীর পানিতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় পর থেকে ওই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জোয়ার ভাটার প্রভাবে ভাঙতে শুরু করে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, দোকান-পাট ও ফসলি জমি। এখনও প্রতিনিয়ত বিলিন হচ্ছে আরও

অনেক নতুন নতুন জায়গা। পানির স্রোতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ফেনীর দাগনভুঁইয়া, সোনাগাজী ও কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট উপজেলার মানুষের মাঝে দেখা দেয় আতঙ্ক। এখনো যাদের ঘর-বাড়ি টিকে আছে তারাও আতংকে দিন কাটাচ্ছেন এই বুঝি বসবাসের শেষ সম্বলটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হলো। প্রসংগত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, নতুন ডাকাতিয়া ও পুরাতন ডাকাতিয়া ছোট ফেনী নদী নিষ্কাশন প্রকল্পের অধীনে মুছাপুর রেগুলেটর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে ২০০৬ সালে

নোয়াখালী-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একান্ত প্রচেষ্টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেগুলেটরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ সালে শেষ করা হয় ২৩ ভেন্টের মুছাপুর রেগুলেটরের কাজ। ১.৩০ লাখ হেক্টর জমি রক্ষার্থে এ প্রকল্প নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২.৩৫ কোটি টাকা। তবে ২০২৩ সালের এক তথ্য অনুযায়ী (রেগুলেটরে বিভিন্ন ভাবে ও বিভিন্ন সময়ে বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী) প্রায় ৫০০কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সরকারের। এই রেগুলেটরে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৭৫৩.১৫ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের

নির্বাহী প্রকৌশলী হালিম সালেহী জানান, স্থানীয়দের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় রেখেই এই ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হবে এব ভাঙনের পরিমান কমে যাবে বলে আশা এ কর্মকর্তা।তিনি বলেন, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পার মাধ্যমে ভাঙনের স্থায়ী সমাধান করার পরিকল্পনা রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। প্রাথমিকভাবে আড়াই কোটি টাকা ব্যায়ে ড্রেজিং এর কাজ শুরু করা হয়েছে। এখানে ড্রেজিং করতেমেশিন চলতে যে তেল খরচ হবে শুধু মাত্র সে খরচ ধরা হয়েছে ।

জেলা প্রশাসক খন্দতার ইশতিয়াক আহমেদবলেন,‘রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার খবরে সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। রেগুলেটর ভাঙার পর দ্রুত জোয়ারের পানি আশপাশের এলাকায় প্রবেশ করছে। যা ওই অঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর। স্থানীয়রা বলছে, যেহেতু দুইপাশে ভাঙছে তাই মাঝখানে একটি ড্রেজিং করলে ভাঙন কিছুটা কমবে। তাদের ওই পরামর্শের ভিত্তিতে এ ড্রেজিং এর কাজ চলমান রয়েছে। আপাতত ভাঙন রোধ করতে পারলে পরবর্তী সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে রেগুলেটরটি পুনঃনির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, মুছাপুরে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। আমরা সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে সেখানকার স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা বলেছি। জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্লুইচগেট নির্মাণ এবং নদীভাঙ্গন রোধের বিষয়ে কথা বলেছি। ড্রেজিং কাজ চলমান রয়েছে, আশা করি শীঘ্রই প্রকল্প অনুমোদনের মাধ্যমে স্লুইচগেট নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এ বিষয়ে আমরা

আবারো প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জেলার জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত মুছাপুরে ডাকাতিয়া নদীর ভাঙনে রাস্তা-ঘাট ও বাড়ি-ঘর হারাচ্ছে শত-শত পরিবার। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্রবল পানির স্রোতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর স্লুইসগেট ভাঙনের কারনে এবং তা পূণঃনির্মান না হওয়ায় নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ঘর-বাড়ি এবং বিস্তীর্ণ ফসলী জমি। হুমকির মুখে পড়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও সোনাগাজী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- নদীর তীব্র ভাঙনে মুছাপুর ৭নং ওয়ার্ডের পুরো গ্রাম বিলীন হওয়ার পথে। আজ যেসব বাড়ী-ঘর, গাছপালা ও স্থাপনা দেখা যাচ্ছে সেটি আগামীকাল আর দেখা মিলছে না। এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে নদীর তীব্র ভাঙনকবলিত এই এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১০০ বছরের পুরনো বাড়ীও উত্তাল নদীর আগ্রাসী ভাঙনে আজ বিলীন।

মুছাপুর ৭নং ওয়ার্ডের সহস্রাধিক ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, মসজিদ, পারিবারিক কবরস্থান, মক্তব ও জনতা বাজারের দোকান-পাট ও বাড়ী-ঘর বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের কবর দেয়া হয়েছিল বসতভিটার পাশে। নিজের পরিবার ও ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও নিতে পারছেন না স্বজনদের কবরগুলি। মা-বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা সেই কবরটি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।

চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে চোখের পানি ছল ছল করলেও বুকের মাঝে কান্না ধরে রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই নদীর তীব্র ভাঙন কবলিত এই এলাকার মানুষের। সহায় সম্বল হারিয়ে কেউ রাস্তার পাশে, কেউ আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় নিচ্ছেন। এভাবে নদী ভাঙ্গায় ভুক্তভোগীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শত-শত হেক্টর রোপা আমন ধানক্ষেত নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, কৃষকেরা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিন-রাত। অপর দিকে মুছাপুর রেগুলেটরে যাওয়ার প্রধান সড়কটির বেশীর ভাগ অংশ ভেঙে গেছে। বনবিভাগের সারি-সারি ঝাউগাছের বাগানটিরও

অনেক অংশ ভেংগে তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই ভাঙছে নতুন নতুন এলাকা। ইতি মধ্যে ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে শত-শত ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, গাছপালা ও মাছের ঘের। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও ফেনীরসোনাগাজী উপজেলার কয়েকটি গ্রাম। স্থানীয়রা জানায়, রেগুলেটর না থাকায় প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পর পর দুই বার জোয়ার আসে। এসময় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর, চরহাজারী, চরপার্বতী ও ফেনীর সোনাগাজীর চরমজলিশপুর ও

চরদরবেশ ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামে। এতে প্রতিদিন ভাঙছে এসব ইউনিয়নের অনেক এলাকা গুলো। চলমান ভাঙনের কবলে ইউনিয়নগুলোর আরও কয়েকটি এলাকাও রয়েছে। জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে আশপাশের মাছের প্রজেক্ট ও ফসলি জমিগুলোতে। যার ফলে বিপর্যয় ঘটছে মৎস্য ও কৃষিতে। ইতোমধ্যে ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে আমনের খেত, ভেসে গেছে অর্ধশত মাছের পুকুর ও প্রজেক্টের মাছ। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় মারা যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ।

নদী ভাঙনরোধ বন্ধ না হলে কোম্পানীগঞ্জ ও সোনাগাজীর অনেক এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে। বিলীন হতে পারে ১ হাজার হেক্টর জমি, যেখানে চাষ হতো আমন, আউশ, বোরো, সরিষা, তরমুজ, ডাল, সূর্যমুখী, শাক-সবজি। সংকটে পড়বে এ অঞ্চলের কোটি কোটি টাকার কৃষি ও মৎস্য খাত।

স্থানীয় বাসিন্দারা আরও বলেন, রেগুলেটর নদীতে বিলীন হওয়ার পর থেকে একের পর এক স্থাপনা, বাড়িঘর ও কৃষিজমি নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙন চলমান থাকলে কোম্পানীগঞ্জ ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দেশের মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন তারা।

তারা আরও বলেন, বন্যায় এমনিতেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। নদী ভাঙনের কারণে এখন ঘণ্টায় একটি করে পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর হারাচ্ছে।ভেঙে যাচ্ছে মসজিদ, রাস্তা-ঘাট। নদী ভাঙন রোধে বাঁধ গুলো সোজা করা না হলে এখানকার অন্তত ১০০০পরিবার ভিটেমাটি সব হারাবে। আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের বাড়ি-ঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজও রাস্তা-ঘাট বাঁচাতে চাই। নদী ভাঙন রোধ করতে ছোট ব্লক ও ছোট জিয়ো ব্যাগ ব্যবহার করা হলেও কাজের কাজ হচ্ছেনা। স্থানীয়রা জানায়, বড় ব্লক এবং বড়

জিয়োব্যাগ ফেলা হলে হয়তো নদী ভাঙন রোধ করা যেত। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রেগুলেটরে ভাঙন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ একর আমন ধানের জমি ও কয়েক একর শীতকালীন সবজির খেত নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এ ভাঙন যেভাবে অব্যাহত আছে ধারণা করা হচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় এক হাজার হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে সংকটে পড়বে এ অঞ্চলের কৃষি খাত।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফেনী থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত বন্যার পানির চাপে ভেঙে যায় রেগুলেটরটি। আর এতেই কপাল পুড়ে রোজিনাদের। রেগুলেটর ভেঙে পড়ার কিছুক্ষণ পর নদীগর্ভে বিলীন হয় তার মাথা গোঁজার একমাত্র বসতঘরটি। নদী ভাঙনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সঠিক তালিকা করে পুনর্বাসন করার দাবি জানান তিনি। মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুরের নদী ভাঙন রোধে ড্রেজিং এর কাজ শুরু করা হয়েছে। যার ফলে গত ২৬আগস্টের পর থেকে বিলীন হয়েছে ওই জনপদের বড় একটি অংশ। ড্রেজিং শুরু করায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে, তবে ড্রেজিং পরবর্তী আবারও রেগুলেটর স্থাপন করে স্থায়ী সমাধানের দাবি এলাকাবাসির।

সরকারের একাধিক উপদেষ্টা মুচাপুর রেগুলেটর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। নদী ভাঙন রোধে তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ছোট ফেনী নদীর জনতা বাজার অংশে ড্রেজিং কাজের শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে স্বস্তি ফিরেছে এ নদী তীরবর্তী ৪টি উপজেলার কয়েক লাখ মানুষের মাঝে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা মেহরাজ জানান, এ ড্রেজিং এর কাজের মাধ্যমে নদীর পানির প্রবাহ পরিবর্তনের পাশাপাশি মাঝ নদী দিয়ে পানি নামা শুরু করলে দুই পাশের আরও কয়েক লাখ মানুষের বসত ঘর রক্ষা হবে। একই সাথে ভাঙন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পুনরায় আরও একটি রেগুলেটর স্থাপনের দাবি তাদের।

উল্লেখ্য, গত ২৬আগস্ট ফেনী থেকে নেমে আসা বন্যার পানির তীব্র চাপে ভেঙে নদী গর্ভে বিলিন হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর রেগুলেটর। তার আগে বন্যার পানি দ্রুত নামার জন্য খুলে দেওয়া হয় রেগুলেটরের ২৩টি গেট (ভেন্ট)। রেগুলেটরটি নদীর পানিতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় পর থেকে ওই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জোয়ার ভাটার প্রভাবে ভাঙতে শুরু করে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, দোকান-পাট ও ফসলি জমি। এখনও প্রতিনিয়ত বিলিন

হচ্ছে আরও অনেক নতুন নতুন জায়গা। পানির স্রোতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ফেনীর দাগনভুঁইয়া, সোনাগাজী ও কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট উপজেলার মানুষের মাঝে দেখা দেয় আতঙ্ক। এখনো যাদের ঘর-বাড়ি টিকে আছে তারাও আতংকে দিন কাটাচ্ছেন এই বুঝি বসবাসের শেষ সম্বলটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হলো। প্রসংগত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, নতুন ডাকাতিয়া ও পুরাতন ডাকাতিয়া ছোট ফেনী নদী নিষ্কাশন প্রকল্পের অধীনে মুছাপুর রেগুলেটর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে ২০০৬ সালে নোয়াখালী-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একান্ত প্রচেষ্টায় তৎকালীন

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেগুলেটরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ সালে শেষ করা হয় ২৩ ভেন্টের মুছাপুর রেগুলেটরের কাজ। ১.৩০ লাখ হেক্টর জমি রক্ষার্থে এ প্রকল্প নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২.৩৫ কোটি টাকা। তবে ২০২৩ সালের এক তথ্য অনুযায়ী (রেগুলেটরে বিভিন্ন ভাবে ও বিভিন্ন সময়ে বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী) প্রায় ৫০০কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সরকারের। এই রেগুলেটরে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৭৫৩.১৫ ঘনমিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হালিম সালেহী জানান, স্থানীয়দের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় রেখেই এই ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হবে এব ভাঙনের পরিমান কমে যাবে বলে আশা এ কর্মকর্তা।তিনি বলেন, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পার মাধ্যমে ভাঙনের স্থায়ী সমাধান করার পরিকল্পনা রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। প্রাথমিকভাবে আড়াই কোটি টাকা ব্যায়ে ড্রেজিং এর কাজ শুরু করা হয়েছে। এখানে ড্রেজিং করতেমেশিন চলতে যে তেল খরচ হবে শুধু মাত্র সে খরচ ধরা হয়েছে ।জেলা প্রশাসক খন্দতার ইশতিয়াক আহমেদবলেন,‘রেগুলেটর ভেঙে যাওয়ার খবরে

সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। রেগুলেটর ভাঙার পর দ্রুত জোয়ারের পানি আশপাশের এলাকায় প্রবেশ করছে। যা ওই অঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর। স্থানীয়রা বলছে, যেহেতু দুইপাশে ভাঙছে তাই মাঝখানে একটি ড্রেজিং করলে ভাঙন কিছুটা কমবে। তাদের ওই পরামর্শের ভিত্তিতে এ ড্রেজিং এর কাজ চলমান রয়েছে। আপাতত ভাঙন রোধ করতে পারলে পরবর্তী সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে রেগুলেটরটি পুনঃনির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, মুছাপুরে প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। আমরা সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে সেখানকার স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা বলেছি। জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্লুইচগেট নির্মাণ এবং নদীভাঙ্গন রোধের বিষয়ে কথা বলেছি। ড্রেজিং কাজ চলমান রয়েছে, আশা করি শীঘ্রই প্রকল্প অনুমোদনের মাধ্যমে স্লুইচগেট নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

আইনজীবী হত্যা: যা বললেন শায়খ আহমাদুল্লাহ ও আজহারী

টাইম রিপোর্ট :চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে নিহত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল...

আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

টাইম রিপোর্ট :চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা...

পুলিশের সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের সংঘর্ষ, আইনজীবী নিহত

টাইম ডোস্ক : চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চের...

নোয়াখালীতে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ায় তিন পরিবহন’র জরিমানা

নোয়াখালী প্রতিনিধি:নোয়াখালী থেকে ঢাকা রুটের যাত্রীদের বাসভাড়া ৫১ টাকা...