এএইচএম মান্নান মুন্না :: দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেল স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ বন্যা। এরমধ্যে ফেনীর পানি নেমে গেলেও নোয়াখালীতে এখনো কাটেনি বন্যার রেশ। গত ১৫ দিন ধরে পানিবন্দি নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ ফলে সেখানকার বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
বন্যা-পরবর্তী খাদ্য সংকটের পাশাপাশি প্রাদুর্ভাববেড়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের।তাদের ঘরগুলোও এখনো বসবাস অনুপযোগী।সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা।
শুক্রবার দিনভর নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ৯ নম্বর দেউটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ আর অসহায়তার চিত্র।সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাঘাটে এখনো হাঁটুসমান পানি। কোথাও বা তার একটু নিচে।
ইউনিয়নের নবগ্রামের ব্যাপারি বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির সাতটি পরিবারই পানিবন্দি।সবার রান্নাঘরেপানি এখনো থৈ থৈ করছে। ঘরবাড়ী থেকে পানি নেমে গেলেও কাদামাটির মধ্যেই বসবাস করছেসাত পরিবারের প্রায় ৪০ জন সদস্য কোনো ঘরেই নেই মাটির চুলায় রান্নার ব্যবস্থা। শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থ মানুষদের নিয়ে এই পরিবারগুলো পানিবন্দি দিন কাটাচ্ছে।এক সপ্তাহ ঘরে বাজার ছিল না, কোনো রকম শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করেছিপানি আর কাদামাটিতে চলাচল করতে করতে পায়ে ক্ষত রয়ে গেছে। পানি নামছেই না।ঘরের ভেতর ইট, কাঠ আর পাটের বস্তা বিছিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। আশপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও একই অবস্থা বলেজানান স্থানীয় বাসিন্দা নুরনবী।
বাড়ির বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা অনেক কষ্টে আছেন। এখানকার কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন।বাকিরা হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল রেখে যেতে পারছেন না। এমন অবস্থায় ঘরেও থাকতে পারছেন না, আশ্রয়কেন্দ্রেওযেতে পারছেন না। সবার ঘরের মেঝে ভেঙে গেছে। পানি নামলে তাদের যেন দ্রুত পুনর্বাসন করা হয়। অন্যথায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ছাড়া উপায় থাকবে না।
বাড়ির ষাটোর্ধ্ব বয়সী নুরনবী বলেন, গত এক সপ্তাহ ঘরেবাজার ছিল না, কোনো রকম শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করেছি। পানি প্রতিদিন আধা ইঞ্চি করে নামলেও এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতাম। আমার ঘরে সাতজন মানুষ। ঘরের ভেতর ইট, কাঠ আর পাটের বস্তা বিছিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে। আশেপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতেও একই অবস্থা। আপাতত অন্য কোথাও গিয়ে থাকার ব্যবস্থা নেই। আরেক বাসিন্দা মো. হারুন বলেন, আমার রান্নাঘর ডুবে চুলা ভেঙে গেছে। পানি উঠার তিনদিন পর টয়লেটও ভেঙে গেছে। এমন দুর্দশায় কোনদিন পড়িনি। পিচ্ছিল কাদামাটি, আর খাটের ওপর আরেকটা চৌকি দয়ে রাতে কোনো রকম ঘুমাই।পুরো ঘরে কাদামাটি জমে থাকায় ইট-কাঠ বিছিয়ে কোনো রকম চলাচল করতে হচ্ছে। এভাবে আজ ১৫ দিন পানিবন্দি।আমরা যেভাবে আছি, এভাবে মানুষ বসবাস করতে পারে না। আমরা কিছু খাল পরিষ্কার করেছি। পানি ধীরে ধীরে নামছে।মাঝেমধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে, তাতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। তবে সব জায়গায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্র চালু আছে।
‘খাবার জোগাড় করতে এখন অনেক কষ্ট। টাকা তো নাই, ঘর ঠিক করব কীভাবে। ঘর ঠিক করতে দু’তিন লাখ টাকা লাগবে।আমাদের শীঘ্র্রই পুনর্বাসনে সরকারের সহযোগিতা দরকার।
শুধু সোনাইমুড়ী নয়, বন্যায় একই পরিস্থিতি জেলার চাটখিল ও সেনবাগ উপজেলায়ও। পানি না নামায় গত কয়েকদিনের দুর্ভোগে নাকাল বানভাসিদের জীবন।
চাটখিল উপজেলার রাজারামঘোষ গ্রামের বাসিন্দা তাজুলইসলাম বলেন, কবে ভালো করে রান্না করেছি জানি না। খাটের ওপর আরেকটি চৌকি দিয়ে ঘুমাইছি সাতদিন। এখন ঘরের মেঝে থেকে পানি নামছে।
কাদামাটিতে হাঁটায় বাচ্চাদের পায়ে ক্ষত হয়ে গেছে। পানিবাহিত রোগবালাইও বাড়ছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা বলেছেন, ফেনীতে দ্রুত পানি এসে দ্রুত পানি নামলেও নোয়াখালীতে পানি এসেছে ধীরে। এখন যাচ্ছেও ধীরে। একটা ইউনিয়নে পানিবন্দি প্রায় হাজার পরিবার থাকলেও পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা নেই।
সোনাইমুড়ী উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী রুহুল হোসেন বলেন, মানুষ দু’তিনদিন পানিবন্দি থাকলে শুকনোখাবার বা আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে সহায়তা করা যায়। কিন্তু দিনের পরদিন সহযোগিতা করা কঠিন।এখনো বন্যার পানি নামছে না।অনেকের বসতঘরে এখনো পানি, রান্নার চুলাও জ্বলছে না। কেউ কেউ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেনবাগ উপজেলার শিক্ষার্থীদের সংগঠন পুসাসের সদস্য হাসান সজীববলেন, বন্যার শুরু থেকে আমরা ত্রাণ বিতরণ করছি। এলাকার পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে না।অনেকের চুলায় আগুন জ্বলছে না।বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় অনেক সামর্থ্যবান ও মধ্যবিত্ত পরিবারও সহায়তা চাইছে। কেউ কেউ ঘরের মায়া কিংবা চোর-ডাকাতের ভয়ে আশ্রকন্দ্রে যাচ্ছেন না।
পানি না নামা পর্যন্ত আমাদের এই অঞ্চলের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। নোয়াখালী জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, জেলায় এখনো প্রায় ১৪লাখ মানুষ পানিবন্দি। আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন এক লাখ ৩৮হাজার মানুষ।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা কিছু খাল পরিষ্কার করেছি। পানি ধীরে ধীরে নামছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টিও হচ্ছে, তাতে পানি ফের বাড়ছে। তবে সব জায়গায় এখনো আশ্রয়কেন্দ্র চালু আছে। পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা বলেন, শুরুতে উপজেলায় পানিবন্দি ছিল ৫০ হাজার, এখন সেটি ২০হাজারে নেমেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ছিল প্রায় ২০০টি, এখন তা কমে ১০০-এর নিচে।
আমরা এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের জন্য ওপর মহল থেকে সহায়তা পাইনি।তবে পুনর্বাসনের তালিকা তৈরি হচ্ছে, চিঠি এলে পাঠিয়ে দেব।পানিবন্দি অবস্থার জন্য বিভিন্ন খাল ও নদী দখলকে দায়ী করছেন জেলার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো।
এক্সমল্লিকা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি স্বেচ্ছসেবী সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান বলেন, নোয়াখালীর দু’একটি জায়গা ছাড়া প্রধান সড়কে পানি নেই।তবে সড়কের দু’পাশেই পানিবন্দি হাজারো মানুষ। গত কয়েকদিন বৃষ্টিও নেই, তবুও পানি নামছে না। আমাদের নদী ও খালগুলো অবৈধভাবে ভরাট এবং দখল হয়ে গেছে। যা পানিপ্রবাহে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।