চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রাজনীতির রহস্য পুরুষ নোয়াখালী জেলার, বেগমগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান ও জাতির গর্বিত সন্তান ৮২ বছর বয়সী “সিরাজুল আলম খান”।
মৃত্যুর পর রাজনীতির এ রহস্য পুরুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক- এমনটা চান না তার পরিবার।
শুক্রবার সিরাজুল আলম খানের ছোটভাই ফেরদৌস আলম খান গণমাধ্যমকে এমনটাই জানান। তিনি বলেন, দাদা ভাই সিরাজুল আলম খান সবসময় প্রচারণার বাহিরে থেকেছেন।
তিনি মৃত্যুর আগে তার কিছু আশার কথা বলে গিয়েছেন। তিনি মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান না। সিরাজুল আলম খান বলে গেছেন তাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়।
এমনকি দাফনের সময় তাকে কাফনের বদলে মায়ের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দাফন করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, মায়ের শাড়িটাই আমার কাছে পতাকা। আমি এই পতাকা নিয়েই আমি চলে যেতে চাই।
সিরাজুল আলম খানের ভাতিজি ব্যারিষ্টার ফারাহ আলম খান বলেন, চাচা বলে গেছেন- মৃত্যুর পরে আমাকে কোথাও রাখার দরকার নেই। আমাকে যেনো ডিসপ্লে করা না হয়।
আমার জন্য হাজার হাজার ফুল আসার দরকার নেই। আমি দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। আমি স্বাধীন করতে পেরেছি। সেটাই আমার বড় অর্জন। আমি কারো কাছে কিছু চাই না।
আগামীকাল সকাল ১০টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মায়ের কবরের পাশেই শায়িত করা হবে।
সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার প্রাণ পুরুষ, নেপথ্যের নায়ক ও সফল স্বপ্ন দ্রষ্টা। বাঙালির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যুব ছাত্রদের মনে স্বাধীনতার অগ্নিশিখা ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র এবং সকল সংগ্রাম আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপান্তর করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার অন্যতম কৌশল প্রণয়নকারী তিনি।
১৯৬২ সালেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস গঠন করেন। এই নিউক্লিয়াসই ছাত্র জনতার আন্দোলন, ৬ দফা ১১ দফা সহ প্রতিটি আন্দোলনকে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির কাজে রূপ দিতে গুরু দায়িত্ব পালন করে।
একাত্তরের পূর্বেই সম্ভাব্য সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে হিসেবে রেখে, বিএল এফ বা মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। জয়বাংলা বাহিনী গঠন, জাতীয় পতাকা তৈরি ও উত্তোলন,জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ভাষণ সহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সাথে সমন্বয় সাধনে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অনন্য ইতিহাসের নায়ক তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন। জাতীয় পার্টির শাসনামলে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক আসম আবদুর রব নেতৃত্বে COP বা Combined opposition Party জাতীয় পার্টি কে সমর্থন দিয়েছিল।তার নেপথ্য ও ছিল সিরাজুল আলম খান।
এরাশাদ কে দিয়ে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরন তথা উপজেলা ব্যাবস্থা প্রবর্তনের নেপথ্যে ও ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আসম রব বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। আমি তখন জাসদ ছাত্রলীগ কোম্পানীগন্জ উপজেলা শাখার সভাপতি ছিলাম। তখন জাসদের অফিস ছিল মতিঝিলের আল্লাওয়ালা ভবনে। ঐ ভবনে তখন বোধহয় জাতীয় পার্টির মহানগরের অফিস ও ছিল। তার কাছেই মতিঝিলের আর একটি ভবনে সিরাজুল আলম খান বসতেন। জাসদ নেতা খিজির হায়াত খান ও সিরাজপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ছায়েদ ভাই সহ ঐ কক্ষে সিরাজুল আলম খানের সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা যখন কক্ষে ঢুকছিলাম তখন আওয়ামীলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মক্তিযুদ্ধের আর এক সংগঠক “তোফায়েল আহমেদ “দাদা সিরাজুল আলম খানের সাথে সাক্ষাত করে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। অনেক্ষন ছিলাম। একটা সাদামাঠা পায়জামা পান্জাবী পরা অতিসাধারণ মানুষের মত খিজির হায়াত এবং আবু ছায়েদ ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন ।
অথছ এই সাদামাঠা মানুষটির চিন্তার ফসল আমাদের স্বাধীনতা।অথছ এই রহস্য পুরুষের মৃত্যুতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র নিরব। অথছ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ৬ দফা প্রণয়ন সহ অনেক কিছুর নেপথ্য নায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
জাতির শ্রেষ্ট সন্তান তোমাকে স্যালুট। আল্লাহ আপনার ভুলত্রুটি সব ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করুক। আমিন।
আবদুর রহিম বাহার
মন্ট্রিয়ল , কানাডা।