স্বাস্থ্য ডেস্ক:
১৩ মাস বয়সী আরবি ভর্তি আছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। শিশুটির মা সুমাইয়া জানান, তাদের বাড়ি সাভারের আশুলিয়ায়। বাড়িঘর ছেড়ে দুই মাস ধরে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন। তিনি আরও জানান, আরবির ৬ মাস বয়স থেকেই সর্দি-জ্বর ঠান্ডা লেগেই আছে। বহু টাকা খরচ হয়েছে, এখনও সুস্থ হচ্ছে না আরবি।
একই ধরনের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে শিশু আফিফা। তার বাবা জনি মিয়া জানান, আফিফার বয়স এখন চার বছর। বছর খানেক আগে নিউমোনিয়া হয় তার। প্রায় ১৭ দিন ধরে শিশু হাসপাতালে ভর্তি। এর পূর্বে আরও দেড়মাস ভর্তি ছিল আফিফা। গত দুই বছরে কমপক্ষে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে সন্তানের চিকিৎসার পেছনে। সরকার থেকে দেওয়া সব টিকা পেয়েছে আফিফা। কিন্তু নিউমোনিয়া সারছে না।
আরবি, আফিফার মতো দেশে কত নিউমোনিয়া আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) সবশের্ষ তথ্যমতে, দেশে বছরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ২৪ হাজার শিশু। আর ৬ লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
দেশে ঘণ্টায় ২-৩টি শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ায় মায়ের দুধে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমে ১৫ ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা নিউমোনিয়া ও ফুসফুসে সমস্যা নিয়ে আসছে
সর্বশেষ ২০২২ সালে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) তথ্য বলছে, ২০১১ সালে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু মারা যেতো নিউমোনিয়ায়। ২০১৭-২০১৮ সালে কমে সেটি হয় ৮ দশমিক শুন্য শতাংশ। এরপর সর্বশেষ ২০২২ সালে হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
যেসব কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের শঙ্কা বাড়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটাদাগে তিন কারণে দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার কমানো যাচ্ছে না। এক হলো, নতুন টিকা না থাকা। দুই নম্বর হলো বায়ুর মানের অবনতি এবং আবধ্য ঘরে রান্নার ধোয়া। তারা বলছেন, নিউমোনিয়া কোনো জীবাণু দ্বারা হচ্ছে সেটির ৫০ শতাংশই এখনও অজানা। সেটি কী ভাইরাসের মাধ্যমে হচ্ছে, নাকি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে তা জানা নেই। নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে হলে এর কারণ জানার উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে।
৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, দেশে নব্বইয়ের দশকে বছরে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু ছিল এক লাখের মতো। এখন কমে তা ১২ হাজারে নেমেছে। এটা ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান। কিন্তু তুলনামূলকভাবে দেশে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু অনেক কমে এসেছে। আর মৃত্যু কমে যাওয়ার কারণ হলো ভ্যাকসিনেশন। আমরা যদি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন শুরু করতে পারি তাহলে মৃত্যু আরও কমবে। তবুও এখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। যদিও এ রোগে কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের
তিনি আরও বলেন, নিউমোনিয়ার কারণগুলোর মধ্যে অপুষ্টি ও গৃহস্থালির দূষণ অন্যতম। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণের বিষয়টি সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে তা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। সেটি ইনডোর কিংবা আউটডোর পলিউশন যেটাই হোক। তিনি আরও জানান, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে শহরের তুলনায় গ্রাম থেকে আসা শিশুদের নিউমোনিয়ার আক্রান্তের হার বেশি। তাই সবাইকে আরও বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ এই চিকিৎসকের।
আইসিডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়া যে উপায়ে আমরা কমাতে পারি এর মধ্যে একটা হলো টিকা। গত এক দশক ধরে রোগটি প্রতিরোধে দেশে হিব-পিসিভি টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ দুটি টিকা কাজ করে নিউমোকক্কাল ও হিমোফিলাস ভাইরাসের বিরুদ্ধে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে নিউমোনিয়া আক্রান্ত বেশি হচ্ছে রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল-আরএসভি ভাইরাস দ্বারা। যার টিকা এখনো সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিশ্বে এ টিকার গবেষণায় পরীক্ষা-নিরিক্ষা শেষ পর্যায়ে।
দেশে বয়স্কদের মৃত্যু বেশি হৃদরোগে, শিশুদের নিউমোনিয়ায় চীনে শিশুদের নিউমোনিয়া বাড়ছে কেন? এ রোগের লক্ষণ কী?
দেশে নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ২৪ হাজার শিশুর মারা যায় তিনি বলেন, নিউমোনিয়া কম হয় যখন বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। গত দশ বছরে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু বায়ুর মান উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা ডা. আহমদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়ার চিকিৎসার আগে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বোঝা, অক্সিজেন স্বল্পতা নিরুপণ করা জরুরি। যথাযথ ওষুধ ও অ্যন্টিবায়োটিক দেওয়া তো আছেই। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে যতগুলো শিশুর নিউমোনিয়া সন্দেহ করা হয় তাদের মধ্যে অধের্কের মতো সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নেয়। আক্রান্তদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অ্যান্টিবায়োটিক নেয়। বাকি এক তৃতীয়াংশ অ্যান্টিবায়োটিক নেয় না।
হাসপাতালের ভেতরে যাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে, সঠিক সময়ে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক পায় এক-চর্তুথাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। এর কোনো পরিবর্তন আনা যাচ্ছে না। হাসপাতালে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনাও ঠিক নেই।
তিনি বলেন, গবেষণায় একশটি শিশুর মধ্যে পাঁচটি শিশুও পাওয়া যায়নি যাদের অক্সিজেন স্বল্পতার বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল। অক্সিজেন দিচ্ছে চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো। যার দরকার ছিল সে হয়তো পাচ্ছে না। যার দরকার নেই তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। মোটকথা নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সার্বিক দিক দিয়ে সতর্ক থাকা দরকার।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসটি। ফুসফুসের প্রদাহজনিত ভয়ংকর রোগ হলো নিউমোনিয়া। অস্বাভাবিক জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বুকে ব্যথা এগুলো হলো নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, ‘আসুন নিউমোনিয়া বন্ধ করার লড়াইয়ে সক্রিয় সহযোগী হই’।