সাহিত্য প্রতিনিধি ফেনী থেকে :
‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ গানের প্রখ্যাত কবি-গীতিকার বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় ব্যক্তিত্ব কবি জাহিদুল হককে ব্যাপক আয়োজনে সংবর্ধনা প্রদান করেছে ‘ফেনী সাহিত্য সভা’।
সম্প্রতি সন্ধ্যায় ফেনী শহরের ইস্টিশন রেস্টুরেন্ট এন্ড কনভেনশন-দরবার হলে আয়োজিত ফেনী সাহিত্য সভার অভিষেক উপলক্ষে বর্ণাঢ্য এ সংবর্ধনার
আয়োজন করা হয়।
এ পর্বের প্রধান অতিথি ছিলেন, সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতার কবি, সাংবাদিক-টিভি উপস্থাপক জাহিদুল হক।
কবি সৈকত রায়হান’র সভাপতিত্বে এ পর্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন ‘স্পার্টাকাস কবি’ খ্যাত সত্তর দশকের বলিষ্ঠ কবিকণ্ঠ জাহাঙ্গীর ফিরোজ, দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ‘ধ্রপদি’র সম্পাদক-কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন ও কবি-গল্পকার তানিম কবির। তৃতীয় পর্বে কবি মো. আবদুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ‘নির্বাচিত ১৫ কবির স্বরচিত কবিতা পাঠের বিশেষ আসর’-এ কবিতা পড়েন কবি জাহিদুল হক, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি আলম মাহবুব, কবি ফিরোজ শাহ, কবি গাজী তারেক আজিজ, কবি আজিম পাটোয়ারী প্রমুখ। এর আগে ফেনী সাহিত্য সভার আহবায়ক কবি-গবেষক শাবিহ মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ফেনী সাহিত্য সভার অভিষেক। এতে বিভিন্ন সংগঠন এ সভাকে অভিনন্দন জানায়। ফেনী সাহিত্য সভার স্লোগান- আমাদের কোনও বৈপ্লবিক ইশতেহার নেই।
ফেনীর মাটিতে বেড়ে ওঠা কবি জাহিদুল হককে সংবর্ধনা স্মারক তুলে দেন দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও কবির সমকালীন সহচর মো. আবু তাহের, প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুল আলম, প্রবীণ নাট্যজন নারায়ন নাগ, ফেনী সাহিত্য সভার সদস্য সচিব বকুল আকতার দরিয়াসহ বিশেষ অতিথিবৃন্দ। এ সময় কবির একটি পোট্রেট স্কেচ ও সংবর্ধনাপত্র তুলে দেয়া হয়। এর আগে ফেনী সাহিত্য সভার অভিষেক ও কবি জাহিদুল হকের ওপর দুটি বিশেষ তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। কবি রাবেয়া সুলতানা ও কবি আর কে শামীম পাটোয়ারীর উপস্থাপনায় শতাধিক-কবি-সংস্কৃতিজনের মেলবন্ধনে এ সময় সভাস্থল মিলনমেলায় পরিণত হয়। অনুষ্ঠানে উক্ত সভার প্রথম প্রকাশনা তথা ‘কবি জাহিদুল হক ক্রোড়পত্রে’র মলাট উন্মোচন করেন অতিথিবৃন্দ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ফেনীর সাধারণ সম্পাদক সমর দেবনাথ, অ্যাডভোকেট-কবি জিয়াউদ্দন বুলবুল, ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক মো: কামাল উদ্দিনসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ সংবর্ধিত কবিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
নেতৃবৃন্দরা বলেন,পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ফেনী মহকুমার সম্পাদক ও সভাপতি থাকাকালে (ফেনী কলেজে পড়ার সময়) কবি জাহিদুল হক মরহুম খাজা আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীকার আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। এখানেই তাঁর কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তাঁকে সংবর্ধিত করে ফেনী সাহিত্য সভা ফেনীবাসীর পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। এই গুণীজনকে সংবর্ধনা প্রদানের মধ্য দিয়ে ফেনীবাসী আজ দায়মুক্ত হল বলা যায়। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কবির বাড়ি হলেও মামাবাড়ি ফেনীতে বেড়ে ওঠায় ফেনী কবির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। কবি ইতিহাসিক কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে নিজেও ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সরাসরি সম্প্রচার না-করার প্রতিবাদে কবি তাঁর কয়েকজন সহকর্মীসহ তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে উক্ত ভাষণটি প্রচারের শর্তে তাঁরা রেডিওতে ফিরে ছিলেন।
বক্তারা আরো বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা ‘আপনি ফিরে আসবেন কবে’ লিখেছেন জাহিদুল হক। কবিতাটি ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ‘এ লাশ রাখবো কোথায়’ নামের সংকলনে কবিতা লিখেও তিনি আদৃত। সে সময় কবি ফেনীতে ‘কুঁড়ি’ ও ‘অনিত্য সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ফেনীর কবিতা ও সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ বেতারের উপ মহাপরিচালক, জার্মানির কোলন শহরে অবস্থিত ‘রেডিও ডয়েচে ভেলে’র সিনিয়র এডিটর ও ব্রডকাস্টার ছিলেন। এর আগে তিনি দৈনিক সংবাদে সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘চির শিল্পের বাড়ি’ নামের একটি সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতির অনুষ্ঠান করেন।
সংবর্ধিত কবি জাহিদুল হক প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ফেনী আমাকে গড়ে তুলেছে। ফেনী পাইলট স্কুৃল ও ফেনী কলেজ এক অর্থে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমি ফেনীবাসীর কাছে ঋণী। আমি ফেনীর মানুষকে ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি। তিনি আরো বলেন, শিল্প সংস্কৃতির মানুষদের উদার হতে হয়। ভালোবাসা বিনিময় করতে হয়। তা না-হলে শিল্প ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।