মাহফুজা খানম গণ্ডী ভাঙা আ’লো’র যাত্রী:লেলিন চৌধুরী

Date:

পয়লা বৈশাখে তাঁর জন্ম। এই দিনে বাঙালি বর্ষবরণের আবাহন বাণী উচ্চারণ করে–‘মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ জন্মক্ষণে গীত এই মহৎ সংগীতটিকে মাহফুজা খানম সারাজীবন ধারণ করেছেন।
মাহফুজা খানমের ডাক নাম হেলেন। তখন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের বাড়িতে তাঁরা থাকেন। পাশের অভয় দাস লেনে তখন জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল বাস করতেন। তাঁর বাড়িতে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের পরিচালনায় শিশুকিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলা সংগঠিত হয়। শুরুর দিন থেকেই হেলেন কচিকাঁচার মেলার সাথে যুক্ত হন। তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। মাহফুজা খানমের বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিরাজ করত। বাবার ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তাঁদের বাড়িতে দেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মনে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তখন দিশা খূঁজে ফিরছে। নিজ বাড়ির পরিবেশ থেকেই মাহফুজার শিশুমনে ক্রমান্বয়ে বাঙালির দেশ-চেতনার সুগভীর ছাপ অঙ্কিত হতে থাকে। তাঁর পরবর্তী জীবনের রাজনৈতিক ভাবনা এবং সামাজিক কার্যক্রম এই চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।

মাহফুজা খানমের স্কুলজীবন শুরু হয় বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে। এখানেই প্রথমে ছাত্র রাজনীতির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। এরপর তিনি ইডেন কলেজে ভর্তি হন। অগ্নিকন্যা নামে খ্যাত বেগম মাতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। একসময় তিনি ইডেন কলেজের উজ্জ্বল গতিশীল নেতায় পরিণত হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জীবন শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়খণ্ড মাহফুজার জীবনের একটি স্বর্ণময় প্রোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বা ডাকসু’র সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মুক্তির সনদ বলে বিবেচিত ছয় দফা ও এগারো দফার প্রচারণায় ধূমকেতুর মতো তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন।

পড়াশোনায় তুখোড় ছাত্রী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের দীপ্ত মশাল মাহফুজা খানমের কোনো সরকারি চাকরি হয় না। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজ কোথাও শিক্ষক হিসেবে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তাঁর অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। মেধার যোগ্যতায় পিএইচডি করার জন্য তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে মাহফুজার পাসপোর্ট ইস্যু করা থেকে বিরত থাকে। ফলে পিএইচডি করতে তিনি লন্ডন যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালটি বাঙালি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের মহত্তোম গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সে সময় দেশপ্রেমিক মানুষের একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে উপনীত করা। সেই উদ্দেশ্যে মাহফুজা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দুঃসাহসের সঙ্গে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করেন। তাঁদের বাড়িটি সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।

পাকিস্তান আমলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি‑বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ না পেয়ে মাহফুজা খানম সদ্য প্রতিষ্ঠিত পুরানা পল্টন গার্লস কলেজে যোগ দেন। তাঁর পছন্দের শিক্ষকতার জীবন শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক হিসেবে সরকারি বিভাগে আত্মীকৃত হন। এর পর ক্রমান্বয়ে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে বেশ কয়েকটি কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। মানিকগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বেও ছিলেন। এ ছাড়া তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

এক বর্ণময় দায়িত্বশীল সামাজিক জীবন তিনি যাপন করেছেন। সচেতনভাবে সক্রিয় রাজনীতির পথ থেকে সরে এসে শিক্ষকতার মাধ্যমে মানুষ গড়া এবং সামাজিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজকে মাহফুজা খানম জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় শিশুকিশোর সংগঠন খেলাঘরের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং চেয়ারপারসন, ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসনের সংগঠন শিশু বিকাশ ছায়ার সভাপতি, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সভাপতি, অপরাজেয় বাংলার সভাপতিসহ অনেকগুলো সংগঠনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট এবং সিণ্ডিকেট সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজে প্রতি বছর বৃত্তি প্রদান করতেন। বহুসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করেছেন। তাঁর মমতাময়ী হাতের ছোঁয়ায় এবং আর্থিক সহযোগিতায় কত মানুষের জীবন সংকটমুক্ত হয়েছে, তার হিসাব তিনি নিজেও বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন।

মাহফুজা খানমের জীবনসঙ্গী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। এই প্রেমময় দম্পতির দুই পুত্র এবং এক কন্যা। বড় পুত্র এবং কন্যা চিকিৎসক এবং মেজো পুত্র আইনজীবী ব্যারিস্টার। মাহফুজা-শফিক দম্পতির নীতিনিষ্ঠতা, সততা প্রায় প্রবাদপ্রতিম। ১৯৪৬ সালের ১৬ এপ্রিল জন্ম নেওয়া দেশপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক এবং কল্যাণকামী মানুষটির জীবনপ্রদীপ ২০২৫ সালের ১২ আগস্ট নির্বাপিত হলো। অক্লান্ত কর্মবীর, শিক্ষানুরাগী, জীবনবাদী মানুষটির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা এবং বিনম্র ভালোবাসা।

লেখক: খেলাঘর কর্মী এবং জনস্বাস্থ্যবিদ

সূত্র:ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন থেকে কপি রাইট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

কোম্পানীগঞ্জব ব্যবসায়ী সমিতির লি:’র বার্ষিক সাধারণ সভা ও বাজেট অধিবেশন

নোয়াখালী প্রতিনিধি :কোম্পানীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি:এর ২০ তম...

বসুরহাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি: এর পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মো: জামসেদ

কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি:আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বসুরহাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি...

বসুরহাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি:-এর সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নূর হোসেন রতন

কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি:আসন্ন বসুরহাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র...

কোম্পানীগঞ্জে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি ::সারাদেশের ন্যায় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আজ...