মুহাম্মদ ইব্রাহিম:: কথায় আছে, সন্তান না কাঁদলে আপন মাও দুধ দেয় না। তাহলে সৎমা’র ক্ষেত্রে কী ঘটবে? এখানে সৎমায়ের একটি গল্প না বললেই নয়।
একদা এক গ্রামে ছিল এক সৎমা। তার সতীন একটি শিশুপুত্র রেখে একদিন মারা যায়। সময় গড়িয়ে চলছে। সৎমার ঘর আলো করে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এখন তার দুটি সন্তান- একটি তার নিজের এবং অন্যটি সতীনের। যাহোক, বিধির লিখন, না যায় খণ্ডন- বলে সে সবকিছু মেনে নেয়। তিনি আর দশ জন সৎমায়ের মতো না। তিনি তার সতীনের সন্তানকে পরম যত্মে বুকে আগলে নিয়েছেন। পাশাপাশি দুই সন্তানের লালন পালনের দৃশ্য দেখে সকলের চক্ষু চরক গাছ।
এই সৎমা নিজের সন্তানকে খাবার খাইয়ে না দিয়ে সতীনের সন্তÍানের মুখে খাবারের লোকমা তুলে দিচ্ছেন। গোসলের সময় সতীনের সন্তানকে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন। অথচ নিজের সন্তানকে নিজে নিজেই গোসল করতে হচ্ছে। কোথাও বেড়াতে গেলে সতীনের সন্তানকে কোলে নিয়ে নিজের সন্তান হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আহা! কী চক্ষু শীতল করা দৃশ্য।
কলির যুগে এসে গ্রামবাসী এক অভাবনীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো। আহা! শেষ জামানায় এটা সম্ভব হয় কি করে? এতো দেখি সৎমা না সাক্ষাৎ দেবী! আহা! এজন্যই বুঝি আল্লায় দুনিয়াডা টিকায়া রাখছে! গ্রামের সবার মুখে মুখে এ সৎমার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর সর্বত্রই কেবল এ সৎমায়ের গল্প।
একদিনের ঘটনা, এই মহানুভব সৎমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, খাঁটি বাংলায় তার সই, তার বাড়িতে বেড়াতে আসলেন। এই মহানুভব সৎমার তেলেসমাতি দেখে সে দিশেহারা।
সকাল গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সৎমা তখন সতীনের ছেলেকে খাটের উপর বসিয়ে তেল পাউডার মাখাচ্ছেন। ঠিক তখন তার নিজের ছেলে সারা শরীরে ধূলা-বালি মেখে হাত-পা ছিলে কান্না করতে করতে ঘরে প্রবেশ করল। এবার তো মহানুভব সৎমার সইয়ের মাথা গরম। ‘কি শুরু করছিস তুই, নিজের পোলার খবর নাই সতীনের পোলা নিয়ে নাচানাচি।…’
এবার সৎমা খুব সন্তর্পণে চারদিকে তাকিয়ে তার সইকে কাছে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল, ‘ধুৎ, তুই তো দেহি হাদারাম গাধাই রয়ে গেলি।’
: কি কইতে চাস তুই?
: শোন তাইলে- আমি সতীনের পোলারে কোলে কোলে রাখি, যাতে ও কখনও হাঁটতে না পারে। ওরে খেলতে দেই না, বাইরে যাইতে দেই না, কারও সঙ্গে মিশতে দেই না যাতে ও বোম্বলদাস বা একটু শুদ্ধ ভাষায় অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী হয়। খেলা-ধূলা করতে দেই না যাতে ওর গ্রোথ কম হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়। সহজেই রোগে আক্রান্ত হয়ে অক্কা পেয়ে ওর মায়ের কাছে আসমানে পাড়ি জমাতে পারে। আর যদি বাইচ্যাও থাকে তাইলে যেন খয়রাত করে খাইতে হয়। এতে করে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
: কস কী তুই! তোর মাথায় এত বুদ্ধি?
: তুই বুদ্ধির দেখছছ টা কী? আমার ছেলে বাইরে যাবে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশবে, খেলা-ধূলা করবে, একটু ব্যথা পাবে তাতে কী? ওর গ্রোথ ভালো হবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবে। আমি ওকে ওর নিজ হাতে খেতে দেই, গোসল করতে দেই, কোথাও বেড়াতে গেলে ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাই যাতে ও ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে।
: ও আচ্ছা, এইবার বুঝলাম তোর আসল তেলেসমাতি।
গল্প থেকে এবার আসি বাস্তবে। প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বাকি সবই খোলা। কিন্তু কেন? এই উত্তর আমার চেয়ে আপনারাই বোধ হয় ভালো দিতে পারবেন।
হাট, ঘাট, মাঠ, বাজার সবই খোলা কোথাও করোনা নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কেবল করোনার স্থায়ী বসবাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময়ে বহু শিশু চোখ হারিয়ে এখন দিনকানা রোগীতে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে মানুষ দিশেহারা। জাতির আগামী দিনের কাণ্ডারি যুবসমাজ কেন চক্রবৃদ্ধি হারে মাদকাসক্ত হচ্ছে, কেন তারা জীবনের মায়া ছেড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে?
মাঝে মাঝে আমাদের ‘সৎমাদের’ কথা শুনলে হাসি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নাকি করোনার হটস্পট। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত অনেক শিক্ষার্থী না খেয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে ঘিঞ্জি, নোংরা, অস্বাস্থ্যকর মেসে জীবনমৃত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দেশের সেরা মেধাবীরা নাকি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, স্বাস্থাবিধি জানে না, আর কলকারখানার শ্রমিকরা খুব ভালোই স্বাস্থ্যবিধি জানে এবং তাতে বেশ ভালোই অভ্যস্ত। আর এ কারণেই করোনাকালে কলকারখানা খোলা ছিল। কী আজব! তাই না।
চাকরির পরীক্ষাগুলো প্রায় দু’বছর যাবত থমকে আছে। কারও যেন কিছুই করার নেই। চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করার দাবিতে বের হওয়া মিছিল পুলিশের লাঠিপেটায় ছত্রভঙ্গ হয়।
কিছু দিন আগে আমার চেম্বারে এক বাবা তার নবম শ্রেণীতে পড়া ছেলেকে নিয়ে আসলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি সমস্যা?।’ বাবা উত্তর দিলেন, ‘সারাদিন গেম খেলে, কিছু খাইতে চায় না।’ ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কয়টা পর্যন্ত গেম খেলো?’
বললো, ‘রাত দুইটা-তিনটা।’
‘ঘুম থেকে ওঠো কখন?’
‘এই দুপুর বারোটা-একটা বাজে।’
‘পড়ালেখা করো না?’
‘স্কুল বন্ধ।’
আচ্ছা, প্রায় এক বছর তো কওমি মাদ্রাসা খোলা ছিল। কই সেখানে তো মিডিয়াগুলো কোন করোনায় সংক্রমণ বা মৃত্যুর খবর দিতে পারল না।
সামনে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের অপেক্ষা। আছে কোরবানি এবং এরপর শীতের গান। ‘আহা! কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে।’ এভাবে করোনার চতুর্থ ঢেউ, পঞ্চম ঢেউ…। ঢেউয়ে পর ঢেউয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাক। হয়তো ‘সৎমায়েরা’ এটাই চায়। যাতে মেরুদণ্ডহীন পঙ্গু জাতি হিসেবে তাদের দয়া-দক্ষিণার ওপর বেঁচে থাকে এবং তাদের কথায় উঠ-বস করে।
‘সৎ মায়েদের’ কাছে করজোড় করে আকুল মিনতি করছি- দোহাই লাগে, আমাদের সঙ্গে এমন করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন। ছাত্র সমাজের ওপর ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিশোধ নিয়েন না প্লিজ! আমাদের আমাদের মতো করে বাঁচতে দিন।
আমাদের করোনার সঙ্গে লড়াই করেই সামনের দিনগুলো বেঁচে থাকতে হবে।