গোলাম সারোয়ার :: হত্যাই খুলে দেয় হত্যার দরজা। এই কথা শেক্সপিয়ার প্রায় চারশত বছর আগে বলে গিয়েছেন। এ বাণীর সত্যতা বিশ্ব ইতিহাসে আমরা বহুবার পেয়েছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেপরেও আমরা বহুবার পেয়েছি।
শুরুটা ভালোই ছিলো। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রটিতে সম্পদের নিদারুণ অভাব ছিলো, যেহেতু পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের ন্যায্য সম্পদের হিস্যা দিয়ে যায়নি। তবুও আমাদের মানুষের মাঝে উদ্যোম, উৎসাহ এবং ভালোবাসার অভাব ছিলোনা। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই অন্ধকারের শক্তি আবার পুনরুত্থিত হতে শুরু করলো অন্ধকারের শরীর বেয়ে। যদিও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের সামনে প্রকাশ্যে কোন অপশক্তি তখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, তবুও ভিতরে ভিতরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অপশক্তিগুলো একত্রিত হতে থাকে। অবশেষে তারা সফল হয়।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বাংলাদেশকে বহুবছরের রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে ফারুক-রশিদ-ডালিমদের ক্যু’য়ের ফলে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসে মূ্ল কুচক্রী খন্দকার মোশতাক। সেই মোস্তাক! রাজনৈতিক ইতিহাসের বহুরূপী সেই অভিনেতা! ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে খালেদ-শাফায়াত-জামিলের প্রচেষ্টায় আরেকটি পাল্টা ক্যু হয়। তার ফলে জিয়া নজরবন্দী হন। এসময়ে ফারুক-রশিদ চক্র দেশছাড়া হয় এবং খন্দকার মোশতাক ৬ নভেম্বর অপসারিত হয়।
কর্ণেল তাহেরের প্রচেষ্টায় ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে আরেকটি পাল্টা ক্যু হয়। এই ক্যু’য়ের ফলে খালেদ মোশারফকে হত্যা করা হয়। এ সময়েই তাহেরদের হঠকারী সিদ্ধান্তে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে জিয়াউর রহমান। যা অবধারিত ছিলো তাই হলো, তাহের প্রতারিত হন। পরে জিয়ার আদেশে তাঁর ফাঁসি হয়। অতএব আমরা দেখতে পাই, ১৯৭৫ সালে ঘাত-সংঘাতময় সময়ে অনেক গ্রুপ কাজ করেছে। তার ভিতরে মোটামুটি চারটি পক্ষ স্পষ্ট হয়।
প্রথমত, ছিলো বঙ্গবন্ধু আর তাঁর বলয়। এই বলয় হলো তখনকার রাষ্ট্রীয় বলয়, আলোর বলয়। বাকীগুলো ছিলো অন্ধকারের বলয়। রাষ্ট্রের ভিতরে তখন মোশতাক ফারুক রশিদ গংদের ছিলো আরেকটি গ্রুপ। খালেদ এবং শাফায়াত জামিলদেরও ছিলো একটি গ্রুপ। আর ছিলো কর্ণেল তাহের, তাঁর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী। জাসদ ও গণবাহিনী ছিলো সক্রিয় এবং দৃশ্যমান, তাই সরকার এই গ্রুপ সম্পর্কে সচেতন ছিলো। রাষ্ট্র অন্য গ্রুপগুলোর ব্যাপারে সচেতন ছিলোনা, যেহেতু সেগুলো গোপনে ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত ছিলো।
জিয়াউর রহমান ছিলেন সেই বিরল মানুষ, যিনি সদরে এবং অন্দরে উক্ত চারটি পক্ষের প্রত্যেকটির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি একাধারে বঙ্গবন্ধুর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে জাসদ ও তাহেরের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখেছেন । তারপর মোশতাক সরকারের সেনাপ্রধান হয়েছেন, আবার ফারুক-রশীদের বিরুদ্ধে শাফায়াত জামিলের এ্যকশন প্ল্যানকেও সমর্থন দিয়েছেন।
১৫ আগস্ট কর্নেল সাফায়েত জামিল ঘটনাটি জানেন সকাল সোয়া ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে। তিনি দ্রুত জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে গেলেন। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, জিয়াউর রহমান তখন সেভ করছিলেন। সাফায়েতের কথা শুনে তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘সো হোয়াট? প্রেসিডেন্ট নেই ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছেন’। নয় দিন পর ২৪ আগস্ট খবর বের হলো সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল জিয়াউর রহমান।
আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের সামনে প্রকাশ্যে গ্রুপ সাবগ্রুপ করার ক্ষমতা বা সাহস কারো ছিলোনা। এমনকি ঘাতকেরা যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে নিচে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনও তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে মেজর মহিউদ্দিন ছিল ম্রিয়মাণ। ১৫ আগস্ট নারকীয়তার পরে মেজর ডালিম রেডিওতে যে ঘোষণা দিচ্ছিল, সেখানেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস করেনি।
পনের আগস্টের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে পাকিস্তান আর আমেরিকা মিলে। এ কাজে তাদের সাহায্য করেছে কিছু দেশীবিদেশী গণমাধ্যম আর কিছু ঘৃণিত এদেশীয় কুলাঙ্গার। ভুট্টো এ হত্যায় এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিল যে তার সরকারই প্রথম স্বীকৃতি দিয়ে দিলো মোস্তাক সরকারকে। আমরা পরে এও দেখলাম, ভুট্টো চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে তাঁর মেয়ে বেনজীর ভুট্রোও আততায়ীর হাতে নিহত হন। এগুলো ইতিহাসের দায় দেনা। এগুলো শোধ করতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেশ তখন কি অবস্থায়! দেশে তখন নতুন প্রচারণা ধর্মের, যেন আগে এদেশের মানুষের ধর্মকর্ম করার সুযোগ ছিলোনা। মোশতাক আহমদ কোন পীরবংশে জন্মেছেন, তার প্রচার চলতে লাগলো। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানপন্থী আমলাদের আনা হলো। খন্দকার মোশতাক তার বিখ্যাত লায়লাতুল কদর ভাষণ দিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জিয়া যখন খন্দকার মোশতাককে কারাগারে প্রেরণ করেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. মতিন চৌধুরী তাকে সম্বোধন করতেন শ্বশুড় বলে। কারণ মোশতাকই তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। আর বন্দিদের ভাষায় কারাগার মানে শ্বশুরালয়।
২৩ নভেম্বর রাত্রে জলিল, আ স ম রব আর হাসানুল হক ইনুকে হঠাৎ করে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। পরদিন আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা তাহেরকে গ্রেফতার করে। জিয়াউর রহমানের আজ্ঞাবহ নতুন সরকার তাঁকে ক্ষমতায় আনা তাহেরকে ঝুলিয়েই দিলেন। আমরা জেনেছি, তারপর থেকে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর প্রতি রাতে কার্ফু দেয়া হতো। শাসকদের হাতে তখন জনগণ ছিল জিম্মি। মানুষের মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হলো।
আমেরিকার সিআইএ যখন কোন গ্রুপকে ব্যবহার করে, তখন তাদেরকেও কিন্তু জীবিত রাখেনা। তার প্রমাণ আমরা পাই স্বয়ং জিয়াউর রহমানের হত্যার মধ্যদিয়ে ৩০ মে, ১৯৮১ সালে। আর জিয়া যে চট্রগ্রামে নিহত হন সে চট্রগ্রামের সেনাবাহিনীর জিওসি মঞ্জুরকেও হত্যা করা হয় অজ্ঞাত হত্যাকারী দিয়ে, যে রহস্য এখনো অজানা। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে একের পর এক হত্যা।
বঙ্গবন্ধু কোন ভুঁইফোঁড় নেতা ছিলেননা যে তাঁকে হত্যা করলেই তিনি হারিয়ে যাবেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের উপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে শ্লোগান দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। পূর্বপাকিস্থান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। মনে রাখার মতো যে, ১৭৫৭ সালের এদিনে পলাশীর আম্র কাননে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল করে। আর এদিনে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ দলটি বাংলাদেশকে মুক্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
আওয়ামী লীগ নামটি প্রস্তাব করেন মাওলানা ভাসানী। তিনিই দলটির প্রথম কমিটির সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ন সম্পাদক। যদিও তিনি তখন নিরাপত্তা আইনে জেলে বন্দী ছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। সেটা ১৯৫২ সাল। ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিল হয়। ঐ কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ধরাশায়ি করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৫৭ সালে মাওলানা দল থেকে বের হয়ে গিয়ে নতুন দল করেন। নাম দেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তখন থেকে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালে তিনি ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয়দফা। বলা যায়, এই হলো আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের ছন্দময় রাজনৈতিক রূপরেখা, রাজনীতির নতুন ব্যাকরণ। তিনি যে পথের রূপরেখা আঁকেন এপথেই বাঙালির ক্রমমুক্তি হয় ১৯৭১ সালে।
ছয়দফার মূল কথা ছিল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৬৮ সাল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। কুর্মিটোলার ক্যান্টনমেন্টের দুর্ভেদ্য দুর্গের এক কক্ষে ট্রাইব্যুনালে চলছে শেখ মুজিবের মামলার শুনানি। সেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাঁকে জেলগেটের ছোট দরজা দিয়ে বের হতে বললে তিনি রাজী হননি। পুরো দরজা না খুললে তিনি বের হবেন না, কারণ শেখ মুজিব কখনো মাথা নত করেননা। ছোটগেট দিয়ে বের হতে হলে মাথা নিচু করতে হয়। এটা শেখ মুজিবের মর্যাদার সাথে যায়না। এই হলো নেতা! তখন পাকিস্তানিরা বলতো, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নাকি ওর্য়াল্ড ক্লাস। সেই ওর্য়াল্ড ক্লাস সেনাবাহিনীকেও শেখ মুজিবুর রহমান পাত্তা দিতেননা। এখনতো সবাই বলে, পুলিশের ভয়ে নাকি আন্দোলন করা যায়না, সত্যের জন্য লড়া যায়না। জেলজুলুমের ভয়ে এখন রাজনীতিবিদেরা সত্য বলেন মেপে মেপে। কিন্তু ইতিহাস বলে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন প্রায় জেলে জেলেই গিয়েছে। বঙ্গের বন্ধু হওয়া অতো সোজা কাজ ছিলোনা।
ঐতিহাসিক ৭ জুন ছয়দফা দিবসের সমাবেশ। পাকিস্তানি সেনারা পুরো পল্টন ময়দান দখল করে ফেলেছে। তারা ভেবেছে এতো অগণিত সেনাসদস্যের মাঠ দখলে বাঙালিরা ভয় পেয়ে ঘর থেকে বের হবেনা। কিন্তু বাঙালিদের তখন ঐন্দ্রজালিক জাদুতে ধরেছে। সমস্ত বাঙালি জাতি নেশাগ্রস্থ। শেখ মুজিবের ডাকের নেশা। মনে হচ্ছিলো, তামাম পাকিস্তানের সব সেনাসদস্য মিলেও মুজিবের সাথে পারবেনা। মুজিবের আঙ্গুলি ইশারায় সব ছাই হয়ে যাবে। সে এক অভিনব দৃশ্য হাজার বছরের ইতিহাসে। মানুষ পল্টনের চারিদিকে ঘিরে ফেললো। এবার মানব প্রাচীরে সেনাবাহিনী বন্দী !
এই হলো মুজিব। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। এবং এই আগুনে মাত্র তিন বছর পরে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুবের কবর রচনা। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হলো বাঙালির জেগে উঠার সময়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের এপর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। প্রচণ্ড রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর প্রজ্ঞার মাধ্যমে হয়ে উঠেন বাঙালির প্রধান নেতা। বাঙালির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনি বাঙালিকে নিয়ে যান স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। আর পাকিস্তানিদের কাছে শুরু থেকেই মুজিব এক অতঙ্কের নাম। এমনকি তা এখনও। তার কারণ আছে। পাকিস্তানে এখনও কিছু কিছু রাজ্যে স্বাধিকারের জন্যে আন্দোলন চলছে। সেসব আন্দোলনরত মানুষের কাছে মুজিবর রহমান অনুপ্রেরণা। সিন্ধু, বালুচ ও পাখতুনদের প্রেরণার উৎস শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তানের নেতাদের জন্যে ক্ষমতার গদি ও জেলখানার দূরত্ব খুবই কম। খুব কম নেতাই আছেন যারা ক্ষমতা হারনোর পর জেলে যাননি। এখন বেলুচিস্তানে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। প্রায় প্রতিদিনই সেনাবাহিনীর হাতে লোক মরছে। পারভেজ মোশারফের শাসনের শেষ দিকে প্রবীণ বালুচ নেতা আকবর খান বুঘতিককে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। বালুচদের হৃদয়ের সে ক্ষত এখনও শুকাইনি।
বেলুচিস্তানের বড় রাজনৈতিক দল হলো বিএনপি (বেলুচিস্তান ন্যাশনালিস্ট পার্টি)। এ দলের নেতা এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আখতার জান মোঙ্গল ২০১২ সালে ছয় দফার দাবি তোলেন। সে দাবি তুলে তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, এটাই বেলুচিস্তানের শান্তির এক মাত্র তরিকা। তিনি এও বলেন, ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলের নেতাদের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফার দাবি তোলেন, বালুচদের বর্তমানের ছয় দফার সাথে তার কোন দ্বিমত নেই। এই হলো শেখ মুজিবের তরিকা। এই তরিকায় এখন শুধু বালুচরা নেই, আছে সিন্ধুর নির্যাতিত মানুষেরাও। আছে পাঠান বা পাখতুনরাও।
ইতিহাসে একজন পাঠান বা পাখতুন নেতা আছে। তিনি খান আবদুল গাফফার খান। তিনি কখনও পাকিস্তান মেনে নিতে পারেননি। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষের গণভোট বর্জন করেছিলেন। তারপর গাফফার খানের ছেলে ওয়ালি খান পাখতুন নেতা হন। এই ওয়ালি খানের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমি ছয় হাজার বছর ধরে পাখতুন, ১৩০০ বছর ধরে মুসলমান এবং ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানি’। আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, মানুষ, মুসলমান । একবার মরে, দুইবার মরে না’। তিনি যখন এই কথা বলেন তখন জেলের পাশে তাঁর জন্যে কবর খোড়া হয়েছে। ভয় পেলে কি আর এতা বড় নেতা হতে পারতেন ?
বিশ্বে অনেক দেশ। সব দেশ ভাগ্যবান নয়। সব দেশ সেরকম নেতা পায়না। অবশ্য সব সময়ও নেতার সৃষ্টি হয়না। সেটা একটি সময়ই ছিল। সমগ্র বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিছু নেতা। ওয়ার্ল্ড ক্লাস নেতা। জোসেফ মার্শাল টিটো, গামাল আবদুল নাছের, আহমেদ সুকর্ণ, জওহর লাল নেহেরু আর শেখ মুজিবের মতো নেতা বিশ্ব সব সময় দিতে পারেনা।
এদেশে এক সময় বড় বড় রাজনতিক দল ছিল। মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ ইত্যাদি। এগুলো আজ বিলীন, ছিন্নভিন্ন। আওয়ামী লীগ আজও প্রবল প্রতাপে টিকে আছে। যেহেতু এটি জনগনের দল, গরীবের দল।
কোন রাজনৈতিক দর্শন তখনই টিকে থাকে যখন তা সময়ের জন্যে দরকারী হয়। সময়ের প্রয়োজনের সাথে খাপখাইয়ে চললে আর সময়ের প্রয়োজনে কাজ করলেই রাজনৈতিক দল বা দর্শন টিকে থাকে। অন্যথায় ইতিহাসের ঐসব এককালের প্রতাপশালী যেসব দল আজ বিলীন তাদের ভাগ্যবরণ করে যেকোন দলকে হারিয়ে যেতে হয়। রাজনীতি হতে হবে মানুষের জন্যে আর তার পথ হতে হবে সত্য ও ঋজু। আমাদের বর্তমান রাজনীতি কি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে? হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালীর এক প্রলয়ের মাসে আমদের এই ভাবনার সময় এসেছে।
লেখক :
গোলাম সারোয়ার
গবেষক ও কলামিস্ট।