শিক্ষকতা পেশার এক দশক – আব্দুল্যাহ নয়ন

Date:

টাইম ডেস্ক :
২০ নভেম্বর ২০১৪ পেশাগত জীবনে আমার প্রথম দিন। সরকারি চাকুরীতে প্রবেশের এইদিন আমার বয়স ছিল ২৪ বছর ৫ মাস ২৩ দিন। আজ আমার চাকুরীর বয়স এক দশক পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালে আমি সদ্য অনার্স পাস করা গ্যাজুয়েট। মনে নানা ধরনের স্বপ্ন। তবে বড় কোন ক্যাডার বা আমলা হওয়ার চিন্তা ছিল না। ইচ্ছা ছিল কোন কলেজের লেকচারার হয়ে সম্মান জনক ভাবে খেয়ে ধেয়ে জীবন কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার রিজিক বরাদ্ধ ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে।

২০১৩ সালে ১ লা জুলাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। আমি বিজ্ঞপ্তিটি দেখলে ও আবেদন করব কি করব না এই সব দ্বিধায় ছিলাম। তখন কলেজের এক ছোট ভাই বলল আবেদন করে পেলেন দেখেন না ভাগ্যে কী আছে!!! তখন সে নিজেই আবেদন টা করে দিল। আবেদন করার পর ভাবলাম পরীক্ষা দিয়েই দেখি। পরীক্ষার প্রবেশ পত্র ডাউনলোড করে দেখলাম কেন্দ্র পড়ল মাইজদী পিটিআই। ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ইং লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো, লিখিত পরীক্ষায় পাস করলাম, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ভাইভা পরীক্ষা হয়,৭ নভেম্বর চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশিত হয়,১৮ নভেম্বর নিয়োগ পত্র ইস্যু করা হয়। ২০ নভেম্বর ২০১৪ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান সম্পন্ন করি। সেই বছর নোয়াখালীতে ২৩৫ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের উপজেলায় নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জন। আমি বেচারা কোন কোটা ছাড়া মেধার ভিত্তিতে যোগদান করি। ঐ ২৩৫ জনের মধ্যে সবাই হয়তো এই পেশায় নেই। যারা আছে তাদেরকে ১০ বছর পূর্তিতে অভিনন্দন।

যোগদানের পর থেকে নিজের পেশাকে ভালোবেসেছি। দিন রাত কাজ করার চেষ্টা করেছি। বিদ্যালয়ের ছুটির পর ও অনেক কাজ করতাম। শেখাতে হলে আগে নিজে শিখতে হয়, প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলাতে হয়। বদলাতে হলে প্রয়োজন নতুন স্থান, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ ও নতুন ধারণা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। আমি বিশ্বাস করি, আমি কি হতে চেয়েছি আর বর্তমানে কি হয়েছি তার উপর আমার পেশাগত উতকর্ষতা নির্ভর করবে না। কারণ আমি অন্তরে-বাহিরে নিজেকে বদলে চলেছি নিরন্তর। আমি বিশ্বাস করি যারা বদলায় না, বদলাতে জানে না তারা স্থবির। আমি সে দলের নয়। বদ্ধ জলাশয় হওয়াটা আমার জীবনের লক্ষ্য নয়। “আমি একজন শিক্ষক” এই বোধ যখন আমার ভিতরের সত্ত্বাকে নাড়া দিতে থাকে, তখন আরো বহু পেশার মধ্যেও এই পেশার একজন হতে পেরে মন গর্বিত হয়ে ওঠে। আজ আমি বুকে ধারন করি- Teaching is a passion not a profession.

যদিও আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ২০ শে নভেম্বর,২০১৪। আমার সত্যিকার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে। দাখিল পরীক্ষা শেষ করার পর থেকে এ যাত্রা শুরু। যদিও সেটা প্রাতিষ্ঠানিক ছিলনা। প্রথম যাদেকে পড়িয়েছিলাম তারা এখন গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছে। একজন Indoor Medical officer (IMO) ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। একজন আমেরিকা ও একজন লন্ডন প্রবাসী। কিন্তু আমি আদম ভাগ্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়ে গেলাম। বিষয়টি হৃদয়ের অন্দরমহলে হতাশার ঝড় তোলে আর বুকের ভিতরের আর্তনাদ নিজেকে বাক্যবানে জর্জরিত করে এই বলে- “ প্রভাতের সুর্য উঠে, তবু কেন আমার কারাকক্ষ বিষাদে ভরা।’’ পরক্ষনেই মনকে প্রবোধ দিই এই বলে-“ আমি শিক্ষক, কঠিনকে করছি সহজ, অজানাকে জানার পথে সদা অগ্রজ।’’

শিক্ষকতা সৃষ্টিকর্তার দেয়া মহান দায়িত্ব। আমি গর্বিত পৃথিবীর সকল পেশার মধ্যে সেরা পেশার একজন হতে পেরে। আমি আরো গর্বিত বোধ করি এই জন্য , আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) একজন শিক্ষক ছিলেন।শিক্ষকদের কল্যাণার্থে তাঁর অন্যতম একটি দোয়া ছিল – “ হে আল্লাহ! সকল শিক্ষককে ক্ষমা করো। তাঁদের দীর্ঘজীবী নেক হায়াত দান করো।’’ পবিত্র ইসলাম ধর্মও শিক্ষকদের উচ্চ আসনে আসীন করেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন- “ তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখো। তাকে সম্মান কর যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর ।’’ (আল-মুজামুল আউসাত :৬১৮৪)

শিক্ষক নামটি বেশ ওজনদার। second mother খ্যাত শিক্ষক, প্রাণিত্বকে মনুষ্যত্বে কনভার্ট করার মহান দায়িত্বে ব্রত। শিক্ষকের কাজ সম্পর্কে বলতে গেলে Burtrand Russell –এর কথাটি না বললেই নয়। তিনি বলেন- শিক্ষকের কাজ দুটি। (১) শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। (২) সেই আগ্রহকে নিবৃত করা । কিতাবে- কলমে কাজ দুটোকে সহজ মনে হলেও প্রাক্টিকালি কাজ দুটো খুবই কঠিন। যারা এ দুটো কাজ সুচারুরূপে করতে পারেন তারাই শিক্ষক। তাদের পদতলে শিক্ষার্থীরা মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য। শিক্ষকদের ও মনে রাখা উচিৎ , “ সবাই যদি পারদকে স্বর্ণ করতে জানে তাহলে স্বর্ণের দামটা থাকবে কোথায় ?” অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠা বহু সাধনার বিষয়।

অসম্ভব সুন্দর যাদু দেখায় জুয়েলাইট । হাতের যাদুর কাঠি হয়ে উঠে ফুলের তোড়া, ডিম থেকে ফুটে হয় ছানা-বাচ্চা, একটি রশিকে ১০ টুকরো করে নিমিষেই জোড়া লেগে দেয়। আর আমরা শিক্ষকরা জুয়েলাইটের চেয়েও বড় যাদুকর। চুম্বুকের মত আকর্ষন করার ক্ষমতা আছে আমাদের। আমাদেরকে কখনো অভিনেতা হতে হয়, কখনো কৃষক হতে হয়,কখনো ডাক্তার হতে হয় কখনো বা আবার খেলোয়াড় হতে হয়,কখনো চিত্র শিল্পী, কখনো কণ্ঠ শিল্পী হতে হয়ে। শিশুর শিখন আনন্দদায়ক ও স্থায়ী করার জন্য এক এক সময় এক এক রকম ভূমিকা রাখতে হয়। আমরা শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে কথার তুবড়ি ছুটিয়ে শিক্ষার্থীদের বিমোহিত করি। একশ আকাশ, একশ নদী, অযুত স্বপ্ন বুকে পুষতে বাধ্য করি । আমরা শিক্ষকরা হচ্ছি রাস্তার মত, রাস্তা যেমন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পথিককে তার গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেয় শিক্ষকরাও তেমনি তাদের শিক্ষার্থীদেরকে স্বপ্নের পথে হাঁটিয়ে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় আর আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি। তাই আমরা শিক্ষকরা গর্ব করে বলতেই পারি- We can make a difference.

তুলনা বিচারে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকতায় প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির পাল্লাই ভারী। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে ও শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। দৈনিক টিপিন ভাতা পান মাত্র ৬.৬৬ টাকা, ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের নামে অর্জিত ছুটি থেকে বঞ্চিত ও অবসরে আর্থিকভাবে ক্ষতগ্রস্থতা, উচ্চতর স্কেল পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত, গ্রেডেশনে সিনিয়র জুনিয়র সমস্যা,পদোন্নতির ক্ষেত্রে জটিলতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘসূত্রীতা, রয়েছে আরো নানা চরম বৈষম্য। এ ছাড়া রয়েছে মান-মর্যাদার প্রশ্ন। আরো কম যোগ্যতার কর্মচারী আরো উপরের গ্রেডে বেতন পাওয়া, সম যোগ্যতায় ১০ম গ্রেড পাওয়া কর্মচারী ও আছে অনেক। আর এসব কারণে প্রাথমিকে অনেক শিক্ষক ঝরে পড়ে। আমরা শিক্ষার্থী ঝরে পড়া নিয়ে কাজ করলে ও শিক্ষক ঝরে পড়া নিয়ে কী কাজ করি?

তবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি শত সমস্যার মাঝেও শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে কাজ করা যায়, অপেক্ষাকৃত উৎকণ্ঠাবিহীন ভাবে থাকা যায়, অপেক্ষাকৃত কম তাঁবেদারি করে থাকা যায়, অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ বিবেক নিয়ে কাজ করা যায়। শিক্ষকতার সার্থকতা- ব্যর্থতা,ভালোলাগা, নালাগা-সবই নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্কের ওপর। শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ওপর। আমি প্রাথমিকের শিক্ষক হয়েছি আপসোস নেই। যখন দেখি আমার ছাত্র-ছাত্রীরা, তাদের অভিভাবকেরা সম্মান দিচ্ছে, তাদের স্বপ্নকে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলে তখন ভালো লাগে, গর্বে বুক ভরে যায়। নিতান্তই ক্ষুদ্র একজন শিক্ষক হিসেবে আমার সকল ক্ষুদ্রতা ঢেকে যায়। ওদের সাফল্যের মাঝে খুঁজে পাই আমার শিক্ষক জীবনের সার্থকতা।

নিজের পেশার প্রতি ভালোবাসা ও প্রচেষ্টার ফলে ২০২৩ সালে কোম্পানীগঞ্জের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে জেলায় ও ২০২৪ সালে নোয়াখালী জেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে বিভাগে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে। আমার প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ সহ এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট যাঁদের আন্তরিকতা আর সহযোগিতায় এ পেশায় এখনও থাকতে পারছি তাদের নিকট কৃতজ্ঞ । প্রিয় শিক্ষার্থী সহ সকলের জন্য রইল আন্তরিক শুভ কামনা । মহান আল্লাহ যেন বাকি সময়টা সুস্থতার সঙ্গে, নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে অতিবাহিত করার এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করার সামর্থ্য দেন এটাই প্রত্যাশা করছি । সকলের নিকট দোয়ার আবেদন রইলো।

লেখকের :ফেসবুক আইডি থেকে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় যা বললেন আসিফ নজরুল

টাইম আন্তর্জাতিক ডেস্ক :ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা...

বাংলাদেশকে বিজেপি ও বিধানসভার বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর হুমকি

টাইম ডেস্ক :পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতা ও বিধানসভার বিরোধী নেতা...

নোয়াখালীতে মৎস্য চাষ প্রশিক্ষণ উদ্ধোধন

নোয়াখালী প্রতিনিধি : ‘দক্ষ যুব গড়ছে দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ এই...