বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক ‘জনযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি দীর্ঘ অথচ ধারাবাহিক আন্দোলনের ফসল। সংগ্রামের ধারাবাহিকতা-স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং চূড়ান্ত লড়াই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অসংখ্য ঘটনা, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে দিক, গোপন পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত জানা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে কত মানুষের অপরিসীম ত্যাগ-অসম সাহসিকতা-বীরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তা সবার জ্ঞাত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কাজের সঙ্গে যে যতটুকু সম্পৃক্ত, সে ততটুকুই জানে। সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা যুক্ত নয় তারা সবকিছু জানার কথা নয়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-তার অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। ‘প্রকাশ্যে’ ও ‘অপ্রকাশ্যে’ এই দুই ধরনের কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সুতরাং যারা এই দুই ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত নয় বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধকে তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হেফাজতে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সিরাজুল আলম খানের সৃষ্টি কাল্ট বা ছায়া শেখ মুজিবুর রহমান যাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিসাবে আমরা সবাই চিনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়াটা সম্ভব ছিলো না এটা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছিল বলেই তারা মুক্তিযুদ্ধের কালে খন্দকার মোশতাককে দিয়ে একটি কনফেডারেশন জাতীয় প্রস্তাব দিয়েও সাড়া পায়নি। সিরাজুল আলম খানের সৃষ্টি জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু,(ছায়া শেখ মুজিবুর রহমান), জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় শ্লোগান জয়বাংলা, জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা ও বাংলার লাল সবুজের মানচিত্র তখন সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহিত হয়ে গেছে এখান থেকে বাঙালি জাতিকে ফিরিয়ে আনা কারো পক্ষেই আর সম্ভব ছিলো না।।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল করলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে পার্লামেন্টারি দলের বৈঠক করছিলেন। ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণাই সিরাজুল আলম খানের হাতে প্রথম স্বাধীনতার অস্ত্রটি তুলে দেয়।সিরাজুল আলম খান সেই অস্ত্র কালবিলম্ব না করে প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু যখন হোটেল পূর্বানীতে তার সংসদীয় দলের সভা করছেন তখনই সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস বাংলার জনগণকে স্বাধীনতার দাবিতে রাজপথে টেনে নামিয়ে ফেলেছেন।এরপর ২রামার্চে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন ও ৩রা মার্চে বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার পুর্নাঙ্গ ইস্তেহারও ঘোষণা হয়ে গেল। বাকি থাকে বঙ্গবন্ধুর নিজের মুখে স্বাধীনতার ডাক সেটাও সিরাজুল আলম খান ৭ই মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুর নিজের মুখে “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ” আদায় করে নিয়েছিলেন।
‘নিউক্লিয়াস’-এর পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মার্চ ডাকসুর ভিপি হিসেবে আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। এই পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রর ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। আসম বর ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় ‘স্বাধীন সার্বভৌম’ বাংলাদেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ইশতেহারটি পাঠ করেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শাজাহান সিরাজ। ঘোষণায় বলা হয়- ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে। উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়াও স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মকৌশল এবং পদ্ধতির দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা দিয়ে কী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ভিত্তি রচিত হয়। এরপরও ঘোষণার আর কী বাকি থাকে? কীভাবে রাষ্ট্রের নামকরণ ‘বাংলাদেশ’ নির্বাচিত হলো, কীভাবে জাতির আত্মপরিচয় পতাকা নির্মিত হলো, কীভাবে জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হলো, কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হলো- এগুলো যাদের জানা নেই তারা কীভাবে সে কথা বলবে? জয় বাংলা স্লোগান কারা নির্ধারণ করেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি কীভাবে প্রদান করা হলো,
২৪ মার্চ সকালে অনির্ধারিতভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের জন্য তৎকালীন গণভবনে বঙ্গবন্ধু রওনা হলেন। তখন তার গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা আর অন্য পাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে দেওয়া হয়।আর এটাই ছিল কনফেডারেশন আলোচনার শেষ পেরেক যা তাদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়।।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাঙালির সংগ্রামী চরিত্র আরও বিকশিত হয়েছিল-সুদৃঢ় হয়েছিল-প্রত্যক্ষ তা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণে উন্মুখ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে স্বাধীনতার পর শাসনক্ষমতার দ্বন্দ্বে সম্পর্কিত করে মূল্যায়ন করা খুবই দুঃখজনক। ‘জাতি-রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের কাহিনী অনুসন্ধান ও গবেষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধর প্রকৃত সত্য তুলে ধরা।
নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগ দাবী করছে তারা অনেক আগেই দেশের মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান সব কিছু ঠিক করেই রেখেছিল।।সে মোতাবেক নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরেই ছাত্রলীগ স্বাধীনতার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে।১৯৭১ সালের ১লা মার্চ আওয়ামীলীগ যখন হোটেল পুর্বাণীতে পাকিস্তান এর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে তাদের সংসদীয় কমিটির সভা করছেন তখন ছাত্রলীগ ঢাকার রাজপথে স্বাধীনতার দাবিতে লক্ষ লক্ষ জনতার মিছিল শুরু করে দিয়েছে।২রা মার্চ লক্ষ লক্ষ জনতার রায় নিয়েই উড়িয়ে দিয়েছে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুকে উপস্থিত রেখেই ঘোষনা করেছে স্বাধীনতার ইস্তেহার যেখানে সবকিছু সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন রাষ্টের প্রধান ও সর্বাধিনায়ক,নবগঠিত রাষ্টের নাম হবে বাংলাদেশ, যার সীমানা হবে ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে। দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে রবি ঠাকুরে” ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি,দেশের জাতীয় শ্লোগান হবে জয় বাংলা।সেনা প্রধান হবেন এম এ জি ওসমানী। এখানে শুধু অভার ছিল একজন নির্দিষ্ট অথরিটির যার একমাত্র এক্তিয়ার ছিল স্বাধীনতার ঘোষনা দেবার।আর সেই এক্তিয়ার ছিল শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।আর সে কারনেই নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগ ৭ই মার্চের ভাষনের শেষ দুটি লাইন ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “ই ছিল তাদের চাহিদা।।আর ২রা মার্চ,৩রা মার্চ আর ৭ই মার্চ হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার পরিপুর্নরুপ।।আর সিরাজুল আলম খান এর রুপকার।।
লেখক :
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান মুরাদ।
সাবেক ছাত্রলীগের নেতা ও বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
লেখকের ফেইসবুক আইডি থেকে সংগৃহীত)