মহানগর টু : আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা

Date:

গোলাম সারোয়ার :: মহানগর ওয়েবসিরিজে যা দেখানো হয়েছে, সেরকম ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটে থাকে। এটি শুধু কোনো বিশেষ সরকারের সময় ঘটে ব্যাপারটা এরকম নয়। সত্য হলো, সব সরকারের আমলে এরকম ঘটনা কমবেশি ঘটেছিলো, ঘটে থাকে। আরো ব্যাপকভাবে বললে বলতে পারি, পৃথিবীর প্রায় সবদেশে কমবেশি এ ধরনের ঘটনার নজির আছে। 

এটি নিয়ে কেন এতবেশি প্রতিবাদ হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। ব্যাপারটা হলো, সিরিজে কোথাও বলেনি, এটি সুর্নিদিষ্টভাবে কোনো সত্য ঘটনার আলোকে তৈরি করা হয়েছে। সিরিজের শুরুতেই বরং নির্মাতা ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো ঘটনার সাথে এই কল্পকাহিনী যদি মিলে যায় তবে তা কাকতাল মাত্র। তবে এটি সত্য, পুরো ওয়েব সিরিজের সব ঘটনাগুলোকে একত্রিত করলে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সাথে কাকতাল হবে। সেক্ষেত্রেও কেউ প্রতিবাদ করে বলতে পারে না, এটি আমাদের উদ্দেশ্য করে বানানো হয়েছে। তাতে স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাদের সময়ে এটি আদতে ঘটেছে। বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি সরকারের আমলে বিরোধীদলগুলো নানান অভিযোগ করে আসছে। সরকারগুলো সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে ঠিক আছে। আবার জনমনে অনেক সময় নানান রহস্যময় কথার জনপ্রিয়তা থাকে। সেসব কিছু ক্ষেত্রে সত্য থাকে, কিছু ক্ষেত্রে থাকে অতিরঞ্জিত। 

রাজনীতির ক্ষেত্রে এগুলো চলতে পারে। কথা হলো, শিল্প সাহিত্যে এটি কেন আসলো। ভারতে এরচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়ে সিনেমা বানানো হয়েছে। ভারত এটি মেনে নিয়েছে। আমরা কেন পারবোনা ? শিল্প-সাহিত্যে প্রতিবাদ বহু আগে থেকে পৃথিবীতে ছিলো, আছে, থাকবে। সেসব হজম করতে শিখতে হবে। সব ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানো হিতে বিপরীত হতে পারে। পাবলো পিকাসো একটি জগৎখ্যাত ছবি এঁকেছিলেন। এর নাম গোয়ের্নিকা। এটি একটি ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে এঁকেছিলেন তিনি। এটি আঁকা হয়েছিলো ১৯৩৭ সালে স্পেনীয় জাতীয়তাবাদী বাহিনীর নির্দেশে জার্মান এবং ইতালীয় যুদ্ধ বিমান কর্তৃক উত্তর স্পেনের বাস্ক কান্ট্রি গ্রাম গোয়ের্নিকায় বোমাবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশ হিসেবে।

পিকাসো সুর্নিদিষ্টভাবে এটি প্রকাশ করেছিলেন। পৃথিবী এই চিত্রকর্ম গ্রহণ করেছিলো। সে হিসেবে মহানগর ওয়েবসিরিজ সুর্নির্দিষ্টভাবে কোনো ঘটনার প্রতিচিত্র হিসেবে নির্মাতা দাবি করেননি। নির্মাতা যেহেতু দাবি করেনি, তাহলে কেউ যদি এটির প্রতিবাদ করে তবে তাদের প্রতিপক্ষরা দাবি করবে, যেহেতু এটি তাদের আমলে ঘটেছে তাই তাদের গায়ে লেগেছে। সে হিসেবে বর্তমান সরকার এই অপরাধগুলোর কারণ না হলেও প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদের কারণে দায়ী হয়ে যায়। এ দায় সরকারে গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছেন প্রতিবাদকারীরা। এটি অনভিপ্রেত। 

আরও একটি কথা। যদি এই সময়েও ঘটে থাকে তবুও কি এসব ঘটনার দায় সরকারের? দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা উপজেলাগুলোতে এখন একই দলীয় আত্মীয়দের মাঝে দলাদলি রেষারেষি চলছে। এই দায় কি সরকার প্রধানের? তারা কি এসব সরকারের উপকারের জন্যে করছে? করছে তো তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। সত্য হলো, তাদের কারণে সরকার নিজেই বিব্রত। সরকার বিব্রত বলেই কেউ কেউ নির্বাচনের সময় সরকারি দল থেকে মনোনয়ন পান না, কেউ কেউ মন্ত্রী থেকে বাদ পড়েন, কেউ কেউ সরকারে থেকেও আবার গ্রফতার হন। কেন হন? সরকার চায় বলেই গ্রেফতার হন। সরকার বিরক্ত বলেই গ্রেফতার করেন। সেক্ষেত্রে এসব ওয়েবসিরিজের মাধ্যমে বরং মানুষ জানছে কাদের কাদের উপর সরকার বিরক্ত। কোন কোন স্টার ব্যবসায়ীদের সন্তানরা বখে গেছে। একজন ব্যবসায়ীর সন্তান বখে গেছে, এই দায় কি সরকারের ? অবশ্যই না। এটি চলমান সময়ের বাস্তবতা। 

যে গোপন রহস্য সবাই জানে কিন্তু যত্রতত্র প্রকাশ করে না তাকে বলে ওপেন সিক্রেট। ওপেন সিক্রেট প্রকাশ করলে কেউ কেউ বিব্রত হবেন। কিন্তু সবকিছুর দায় সরকারের হতে পারে না। এগুলো ব্যক্তির অপরাধ, গোষ্ঠীর অপরাধ। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায় নিশ্চয় সরকারের নয়। মনে রাখবেন; এটি একটি ওয়েবসিরিজ, ডকুমেন্টারি নয়।

এখন আসি এই ওয়েবসিরিজের ইতিবাচক দিক কোনগুলো। ইতিবাচক দিক হলো দেশের সব রাজনৈতিক নেতা একসাথে নষ্ট হয়ে যাননি। আশফাক নিপুন দেখিয়েছেন, একজন মেয়র শহরে মেয়েদের একটি টয়লেট বানানোর জন্যে লড়ছেন। দেখিয়েছেন বিস্তৃত বিচ্যুত সিস্টেমের ভিতরে থেকেও একজন পুলিশ অফিসার মাথা খাটিয়ে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন সত্যকে বাঁচাতে, নিরীহকে বাঁচাতে। পরিস্থিতির সাথে মিশে গিয়ে তিনি বের করে আনছেন সত্য। বৃহৎশক্তিতে নিয়ে আসছেন জালে আর নিরীহ ক্ষুদ্র মানুষকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছেন। 

দেখিয়েছেন একজন মডেল নারীর একজন ভগ্নিপতি ধর্মের দোহায় নিয়ে বিপদগ্রস্ত শালীকে মধ্যরাতে বাসা থেকে বের করে দিলেও একজন ধনী চরিত্রহীনের টাকা খেয়ে শালীতে তার হাতে তুলে দেয়ার জন্যে খুঁজতে বের হয়েছে। মানে আমরা যাদের ধর্মপ্রাণ হিসেবে জানি তারা সবাই আসলে মনেপ্রাণে ধর্ম লালন করেনা। দেখিয়েন সমাজে আসলে দু’ধরণের শক্তি লড়ে যাচ্ছে, এটি শুভ এবং অন্যটি অশুভ। এখানে যা দেখানো হয়েছে তাতো মানব সভ্যতার সবযুগেরই বাস্তবতা। এখানে এত রিএ্যক্টের কি দরকার ছিলো ! ওটিটি ওয়েবসিরিজগুলোর সমালোচনা হতে পারে তাদের ভাষা ব্যবহারের পরিশীলতার ঘাটতি দেখে। কিন্তু তাদের ক্রিয়েটিভি, তাদের বৈচিত্র্য এবং ডুবন্ত চলচ্চিত্র শিল্পকে টেনে তোলার যে আশা তাদের কাজে দেখছি তাতে তো তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত। 

আমাদের সময় হয়েছে ভালোকে ভালো বলার। আমাদের সময় হয়েছে ট্যালেন্টদের সাথে থাকার। আমাদের সময় হয়েছে বিশ্বমানের সিনেমা বানানোর। আমরা স্টিভেন স্পিলবার্গ কিংবা জেমস ক্যামেরুন কোন রাজনৈতিক দল করে তা দেখবো না। আমরা দেখবো তাদের প্রতিভা, তাদের সমাজ দর্পন, তাদের সময়কে ধরে ফেলার ক্ষমতা, তাদের বিশ্বজয়ের উচ্চাবিলাস। একটি মানুষ এক বয়সে একরকমের ম্যাসিউরিটি ধারণ করে। একটি মানুষ দশবছর আগে যে দর্শন লালন করতো তা দশ বছর পরেও লালন করবে তার নিশ্চয়তা নেই। এদেশে একসময় প্রচার ছিলো সিনেমা দেখলে নরকে যেতে হয়। আবার এই দেশেই বহু বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতা ওঠে এসেছে মাদ্রাসা থেকে পাস করে। তাই কোনো মানুষকেই কোনো দর্শনে বেধে রাখার কোনো নিশ্চয়তা নেই, নেই কোনো যৌক্তিকতা। 

আমরা যদি একে একে সবাইকে শত্রু বানিয়ে ছেড়ে দিই তবে আমাদের সেক্যুলার পৃথিবী কারা বানাবে? একটি সেক্যুলার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিয়ামক হলো সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতি যারা লালন করে তাদের পর করে দিতে নেই। তাদের যথা সম্ভব কাছে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। তা না করে একে একে সবাইকে শত্রু ভাবা ঠিক নয়। 

আবার একটি দেশের সবাই একটি দলই করবে, এটি আশা করাও ঠিক নয়। একজন এক মতবাদ লালন করবে। এটি সুন্দর । পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর এবং যোগ্য যুদ্ধ হলো ইন্টিলিজেন্টদের যুদ্ধ। ইউরোপে একবার হয়েছিলো দার্শনিকদের বুদ্ধিভিক্তিক যুদ্ধ। এটি হয়েছিলো তাদের সোনালী সময়ে। একজন একটি সিনেমা আপনার প্রতিকূলে বানালে আপনি দশটি বানান। তাকে হারিয়ে দিন। তা না করে তাকে নিরুৎসাহিত করা দেশের, জাতির কিংবা সময়ের পক্ষে কোন কাজ নয়। 

চরমপন্থা সবক্ষেত্রে খারাপ। এটি ডান, বাম কিংবা খোদ সেক্যুলার রাজনীতির ক্ষেত্রেও খারাপ। অসহিষ্ণতা কোনো জাতির জন্যেই ভালো নয়। অনেকে অনেক সময় অভিযোগ করে থাকেন, দলের জন্যে কি না করেছি। কিন্তু কী পেলাম? তারা অভিযোগ করেন তারা অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন। অনেকের সাথে ঝগড়া করেছেন, কিন্তু দল মূল্যায়ন করে না। 

কেন এটি হয়? কারণ সরকার চালাতে রেশনাল লোক লাগে। চরমপন্থী দিয়ে হয়তো মাঠ চালানো যায়, কিন্তু সরকার কিংবা প্রশাসন চালানো যাবে না, যায়না। তাই সরকারগুলো সবসময় সহনশীল জ্ঞানী ব্যক্তিদেরই এগিয়ে দিয়ে থাকেন। আমার ধারণা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন মধ্যপন্থী সহনশীল মানুষ। তিনি চরমপন্থী কাউকেই পছন্দ করেন না। সে কারণেই দিনের পর দিন বছরের পর বছর যারা খুঁজে খুঁজে শত্রু বের করে অবিরাম ঝগড়া করে যাচ্ছেন তাদের কোনো ভালো জায়গাতে নিয়ে যেতে পারছেন না। আশা করি সেক্যুলার মানুষেরা সহনশীল হয়ে উঠবেন। কারণ একটি কাক্সিক্ষত পৃথিবীর জন্য সেক্যুলারদের জিততে হবে। আর পৃথিবীর সব শিল্প সাহিত্যের আলটিমেট মালিক হলো সেক্যুলাররাই। 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

সেনাকুঞ্জে কুশল বিনিময় করলেন ‍মুহাম্মদ ইউনূস-খালেদা জিয়া

টাইমস ডেস্ক :: বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল...

কোম্পানীগঞ্জে ট্রাক চাপায় শিশু নিহত

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি :: নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইটবাহী ট্রাক...

বিদেশ যাওয়া হলো না কলেজ ছাত্র জাকিরের, প্রশিক্ষণ শেষে বাড়ী ফেরার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত

নোয়াখালী প্রতিনিধি :: নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চৌধুরীহাট ডিগ্রি কলেজের এক...

লক্ষ্মীপুরে উপজেলা-পৌরসভায় জামায়াতের আমির নির্বাচিত

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: লক্ষ্মীপুরে উপজেলা ও পৌরসভা জামায়াতের নির্বাচিত...