হেলাল হাফিজের স্কুল জীবনে হেলেনের সাথে প্রেম!

Date:

টাইম ডেস্ক:

হেলাল হাফিজের স্কুলজীবনে হেলেনের সাথে প্রেম হয়, তারা ছিলেন প্রতিবেশী। দীর্ঘ প্রেমের পর দুই পরিবারে ঘটনাটি জানাজানি হয়। হেলেনের বাবা ছিলেন দারোগা আর হেলাল হাফিজের বাবা স্কুলশিক্ষক। হেলাল হাফিজের বাবা দারোগার মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চাননি, এ নিয়ে দুই পরিবারে বিরোধ ঘটে এবং হেলাল হাফিজ হেলেনকে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বললে হেলেনও নির্বিকার থাকেন। পরে হেলেনের বিয়ে হয় ঢাকার একটি সিনেমা হলের (সম্ভবত মুন সিনেমা হল) মালিকের সাথে।

সেই বিয়ের পর কবি নাকি দশ-বারো দিন কোনো কথা বলতে পারেননি, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হেলেনের বিয়ের পর কবির পরিবার তাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। একদিন তারা একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে তার কাছে জানতে চায়, মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না। কবি উত্তরে বলেছিলেন, মেয়েটি দেখতে তার মায়ের মতো। এরপর পরিবারের লোকজন লজ্জায় আর কখনো তাকে বিয়ের কথা বলেনি। আমৃত্যু তিনি বিয়ে না করে হেলেনকে ভালোবেসে নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে এমন সাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিয়ে না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি কখনো হেলেনকে দোষ দিতেন না, এমনকি হেলেনের প্রসঙ্গও আনতেন না। তিনি বলতেন, “আমি কাউকে বিয়ে করিনি—এমনটা ঠিক নয়। বরং কেউ আমাকে বিয়ে করেনি—এমনও হতে পারে।”

হেলেনের বিয়ের পরে তীব্র দুঃখ বুকে চেপে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান হেলাল হাফিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়াও করেছেন। ব্যতিক্রমী ও সহজবোধ্য কবিতা লেখার ফলে তার খ্যাতি ক্যাম্পাস থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল দেশব্যাপী। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আলোড়ন-সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।

হেলেনের স্বামী বইমেলা থেকে অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটিও কিনে বাসায় নিয়ে যান। হেলেন যখন দেখতে পেলেন বইটির পুরোটা জুড়ে বিধৃত আছে হেলেন-হেলাল প্রেমউপাখ্যান, আছে হেলালের কষ্টের ইতিবৃত্ত আর হেলেনের জন্য হেলালের শব্দে-শব্দে নিঃশব্দ হাহাকার; তখন ক্রমশ তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। হেলেনের স্বামী দেশে-বিদেশে হেলেনের উচ্চচিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও হেলেন আর ভারসাম্য ফিরে পাননি। একপর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে হেলেন তালাকপ্রাপ্ত হন। হেলেন এখন নেত্রকোনায় আছেন। এখন তিনি বদ্ধ-উন্মাদ। নেহাল হাফিজের ভাষ্যমতে— হেলেনকে এখন শেকল পরিয়ে ঘরে বেঁধে রাখতে হয়, ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় ওষুধ খাইয়ে; অন্যথায় তিনি ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। [হেলাল হেলেনের মর্মান্তিক গল্পের তথ্যসূত্রঃ কবি আখতারুজ্জামান আজাদ]

আমরা মনে করি, কবিদের জীবন নারীবেষ্টিত হয়ে থাকে। কিন্তু সব সময় আমাদের ধারণা সত্য হয় না। রূপবতী মেয়েরা কবিতার প্রেমে পড়ে, এলোমেলো অগোছালো কবির প্রেমে নয়।

হেলাল হাফিজ একজনকেই ভালোবেসে সারাজীবন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। নিঃসঙ্গতাই ছিল তার প্রিয়। কবির জীবনে একটি মাত্র মৌলিক কাব্যগ্রন্থ “যে জলে আগুন জ্বলে” প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। এরপর তিনি আর কোনো বই প্রকাশ করেননি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “প্রথম বইয়ের জনপ্রিয়তা আমার লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। জীবনের সব অনুভূতিই এই বইয়ে দিয়েছি। এরপর লিখলে যদি আগের মতো জনপ্রিয় না হয়, তা আমি সহ্য করতে পারব না।”

আমার মনে হয়, এই “যে জলে আগুন জ্বলে” কাব্যগ্রন্থটি শুধুই হেলাল হাফিজের নয়, বরং সকল প্রেমিক হৃদয়ের মনের অব্যক্ত কথার সমন্বয়।

“যে জলে আগুন জ্বলে” কাব্যের ৬২ কিংবা ৬৪ কবিতার প্রতিটি আমাকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছিল।

হেলাল হাফিজের সাথে আমার প্রথম পরিচয়, প্রিন্স মাহমুদের সুরে বের করা “এখনো দুচোখে বন‍্যা” এলবাম থেকে। সেই এলবামের কাভারে প্রিন্স মাহমুদ, হেলাল হাফিজের একটা কবিতার নিচের অংশটুকু জুড়ে দিয়েছিলেন। কবিতাটি ছিল:

আমি কি নিজেই কোন দূর দ্বীপবাসী এক আলাদা মানুষ? নাকি বাধ্যতামূলক আজ আমার প্রস্থান,
তবে কি বিজয়ী হবে সভ্যতার অশ্লীল স্লোগান?

আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।

আমার কী এসে যাবে, কিছু মৌল ব্যবধান ভালোবেসে
জীবন উড়ালে একা প্রিয়তম দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

নষ্ট লগ্ন গেলে তুমিই তো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
সুকঠিন কংক্রিটে জীবনের বাকি পথ হেঁটে যেতে যেতে
বারবার থেমে যাবে জানি
‘আমি’ ভেবে একে-তাকে দেখে।
তুমিই তো অসময়ে অন্ধকারে
অন্তরের আরতির ঘৃতের আগুনে পুড়বে নির্জনে।

আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফাল্‌গুনে।
আমার কী এসে যাবে

হেলাল হাফিজ অত‍্যন্ত শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় কবি। লিখেছেন কম। প্রেম করেছেন জীবনভর। আলস‍্যে কাটিয়ছেন। সংসার করেননি কখনো। আজ নিঃসঙ্গ অবস্থায় চিরতরে বিদায় নিলেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি খ্যাত কবি হেলাল হাফিজ (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নইলাহি রাজিউন)।

  • বিদায় হে চিরকুমার কবি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

Popular

More like this
Related

উদীচী নোয়াখালী জেলা সংসদ’র সম্মেলন মামুন সভাপতি, অজয় সাধারণ সম্পাদক

টাইম ডেস্ক :"আমরা তো লড়ছি সমতার মন্ত্রে, থামবোনা কখনোই...

আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক বসুরহাট শাখার কম্বল বিতরণ

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি:দুস্থ শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করছে...

কোম্পানীগঞ্জে তারুণ্যের উৎসব প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ

কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি :: “এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই”...

কোম্পানীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র ও গুলি’সহ আটক-১

সোহরাব হোসেন বাবর, কোম্পানীগঞ্জ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি :: নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ...